পৃথিবীতে অন্যান্য মৌলের তুলনায় স্বর্ণের পরিমাণ খুবই কম। সে কারণে অর্থনীতিতে স্বর্ণের কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে স্বর্ণের মজুদ। ১৮ শতক থেকেই মূল্যবান এ ধাতু রাষ্ট্রীয় সম্পদ সংরক্ষণের নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৯৭০ এর দশকে আনুষ্ঠানিকভাবে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড পরিত্যক্ত হয়। তবুও অনেক দেশ এখনও স্বর্ণের মজুত বাড়িয়ে চলেছে।
এদিকে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে স্বর্ণের রিজার্ভের চাহিদাও বাড়ছে। বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সম্পদ সংরক্ষণের জন্য স্বর্ণকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এছাড়াও একটি দেশের ঋণযোগ্যতা ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থানকে সংহত করতে স্বর্ণের মজুত সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও বাংলাদেশ স্বর্ণ রপ্তানি বা মজুতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পিছিয়ে আছে। দেশে স্বর্ণের বাজারের আকার প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। স্বর্ণ ব্যবসার সাথে যারা জড়িত তাদের মতে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ স্বর্ণের বাজার প্রায় ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। তবে টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য দরকার সঠিক রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা। এদিকে বর্তমানে সোনার অলংকার বিক্রির ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ। সেটিকে পরিবর্তন করে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা দরকার বলে মনে করেন স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) কর ও শুল্ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, 'রাজস্ব কীভাবে বাড়বে সেই প্রোপোজালগুলো আমরা বাজেটের আগে দেই। কিন্তু তারা এগুলোকে তেমন একটা নজরে আনে না। সাধারণত কাস্টমাররা এতো বেশি ভ্যাট দিয়ে অভ্যস্ত না। স্বর্ণের দাম এমনিতেই বেশি। আমাদের এখানে ভ্যাটের পরিমাণ কমালে তারা বিদেশমুখী হতো না।'
এদিকে দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাজুস মতে, ভারতের সাথে বাংলাদেশের স্বর্ণের দাম ভরি প্রতি পার্থক্য অনেক টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই পার্থক্য ১০ হাজার টাকারও বেশি। দেশে স্বর্ণের বিক্রয়মূল্যের সঙ্গে আবশ্যিকভাবে সরকার নির্ধারিত ৫ শতাংশ ভ্যাট এবং বাজুস নির্ধারিত গহনার নূন্যতম মজুরি ৬ শতাংশ যুক্ত হয়। সবমিলিয়ে এক ভরি স্বর্ণের অলংকার কিনতে বাংলাদেশে মোট ১ লাখ ২৯ হাজার ৮১৯ টাকা লাগছে। অন্যদিকে ভারতে এক ভরি স্বর্ণের ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ হারে ভ্যাট এবং মজুরি দিয়ে এক ভরি স্বর্ণের অলংকার কিনতে লাগছে প্রায় ১ লাখ ১৯ হাজার ২৫৯ টাকা।
বাজুসের প্রাইস মনিটরিং কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান বলেন, 'আমদানির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ ভ্যাট, এআইটি ৫ শতাংশ প্রতি ভরিতে ২ হাজার টাকা ট্যাক্স এছাড়াও লজিস্টিক একটা খরচ আছে। এগুলো হিসেব করলে ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ ট্যাক্স পড়ে যাচ্ছে।'
২০১৮ সালে 'স্বর্ণ নীতিমালা' অনুমোদন দেয়া হলেও ২০২১ সালের অক্টোবরে তা সংশোধন করা হয়। স্বর্ণালংকার বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ভ্যাট হার পরিবর্তনের দাবি ব্যবসায়ীদের। তাহলে তৈরি পোশাক শিল্পের মতো জুয়েলারি শিল্প একটি অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত হয়ে উঠবে বলে মনে করেন স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা।
বাজুসের সহ-সভাপতি রিপনুল হাসান বলেন, 'আমি যদি আজকে এলসি ওপেন করি তাহলে সেই পণ্যটা আমার হাতে পেতে সর্বনিম্ন ১৫ থেকে ২০ দিন লাগছে। স্বর্ণের দাম মিনিটে ওঠানামা করে। সেখানে আমদানি করে ১৫ দিন পর দাম কী থাকবে এটা তো আল্লাহ ছাড়া কউ জানে না। এই রিস্কে যাওয়ার চেয়ে যদি আমি খোলা বাজারে পেয়ে যাই তাহলে আমি কেন এতো ঝামেলায় যাবো। যার কারণে আমাদের আমদানিকারকরা হতাশাগ্রস্ত হচ্ছে।'
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই প্রথম স্বর্ণ পরিশোধনাগার শিল্প স্থাপন করতে যাচ্ছে। এতে করে 'মেইড ইন বাংলাদেশ' সংবলিত স্বর্ণের বার রপ্তানির সুযোগ তৈরি হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য মো. আব্দুল কাফির মতে, স্বর্ণ থেকে রাজস্ব আয় বাড়াতে আমদানি প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে, একইসাথে কমাতে হবে শুল্ক।
তিনি বলেন, 'ব্যাগেজ রোলের আওতায় যে স্বর্ণগুলো আসে তাতে খুব একটা ইফেক্ট পড়ে না। চোরাচালানের মাধ্যমে আসা স্বর্ণের ওপর বেশি ইফেক্ট থাকে বাজারে। আমার মনে হয় এখানে সংশোধনের অনেক সুযোগ আছে। বিদেশ থেকে স্বর্ণের যে একই আইটেম ১২ পিস পর্যন্ত আনা যাবে, এটা আসলে কর্মাসিয়াল কোয়ান্টিটি হয়ে যায়। এই সংখ্যাটা কমানো প্রয়োজন। এটা সর্বোচ্চ ৬ পিস পর্যন্ত হতে পারে।'
দেশের অন্যতম রপ্তানি খাত হিসেবে গড়ে উঠতে জুয়েলারি শিল্পের সক্ষমতা তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তবে সরকারকে সবার আগে স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ তাদের।
সিপিডি'র গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'এটা পুরোপুরি একটা ইনফরমাল সাপ্লাই চেইনে এসে দাঁড়িয়েছে। এখানে অনৈতিক ট্রান্জেকশনগুলো সবচেয়ে বেশি। এ রকম একটা সাপ্লাই চেইনের মাধ্যমে কোনোদিনই রপ্তামুখী তো দূরে থাক অভ্যন্তরীণ সাপ্লাই চেইনই গড়ে তোলা সম্ভব না। বাজুসের উচিত হবে সরকারের সহযোগিতা নিয়ে স্বর্ণের সমস্ত আমদানি রাপ্তানিগুলো ফরমালাইজড হয়, সে দিকে নজর দেয়া।'
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তথ্যমতে, গত একবছরে যদি বৈধ পথে স্বর্ণ আমদানি করা হতো, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকে ২২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ জমা পড়তো। এ থেকে সরকার রাজস্ব পেতো প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।