ইসরাইল-হামাস সংঘাতে নিহত ফিলিস্তিনিদের তালিকায় প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে মানবাধিকার কর্মী, প্যারামেডিক ও স্বেচ্ছাসেবকদের নাম। গেল বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ফিলিস্তিনের গাজায় নিহত মানবাধিকার সংখ্যা ১৭৮। দুই বছরে নিহত মানবাধিকার কর্মীর সংখ্যা ৩৩০ ছাড়িয়েছে, যা জাতিসংঘের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
শুক্রবার অধিকৃত গাজার কামাল আদওয়ান হাসপাতালে ড্রোন হামলা চালায় ইসরাইল। এ হামলায় ৪ স্বাস্থ্যকর্মী ও দুই রোগী গুরুতর আহত হলে প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকারের প্রশ্নে অবিলম্বে এই যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে।
মানবাধিকার কর্মীদের ওপর হামলা শুধু ফিলিস্তিনেই সীমাবদ্ধ নেই, লেবাননেও ভয়ংকর পরিণতির মুখে জাতিসংঘের মানবিক সংস্থায় নিয়োজিত কর্মীরা। শুক্রবার দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের একটি হাসপাতালে হামলা চালায় ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী। হামলায় হাসপাতাল পরিচালকসহ ৬ স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হলে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে লেবাননের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
লেবাননের স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর এই হামলার নিন্দা জানিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২০২৩ সালে ইসরাইল-হিজবুল্লাহ সংঘাতে জড়ানোর পর থেকে এখনও পর্যন্ত দেশটিতে ২২৬ জন স্বাস্থ্যকর্মী ও রোগীর প্রাণাহানি হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা আইনে যুদ্ধক্ষেত্রে মানবাধিকার কর্মীদের সুরক্ষা দেয়ার বিধান আছে। এ আইন না মানলে সংশ্লিষ্ট দেশের নেতাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে এমন নজিরও পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক এই আইন যেভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে মানবাধিকার সংগঠনগুলো যুদ্ধ কবলিত অঞ্চলে কর্মী পাঠাতে সংশয়ে পড়তে পারে বলে মনে করছেন 'ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর কোঅর্ডিনেশন অব হিউম্যানেটেরিয়ান এফেয়ার্স'র এর কর্মকর্তারা।
ওসিএইচএ মুখপাত্র জেনস লার্কে বলেন, ‘যারা সামনের সারিতে থেকে মানবিক সহয়তা দিচ্ছেন তারা আমাদেরই সহকর্মী, দেশের সম্পদ। মানুষের সর্বোচ্চ সেবা দিতে গিয়ে তারা নিহত হচ্ছেন। এটা দেখে কেউ চুপ করে বসে থাকতে পারে না। আপনার ধর্মীয় বিশ্বাস বা পরিচয় যাই হোক না কেন, মনে রাখবেন, ঐ কর্মীরা মানুষের সৃষ্টিকর্তার দূত হয়ে কাজ করছেন আর এর পুরস্কার হিসেবে আমরা তাদের হত্যা করছি।’
মধ্যপ্রাচ্যে চলমান আগ্রাসনে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কর্মীদের ওপর ইসরাইলি হামলার প্রতিবাদে বারবার আন্তর্জাতিক যুদ্ধ আইনের প্রসঙ্গ টানছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেন বা জাতিসংঘ। মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যে পরোয়ানা জারি করেছে সেখানেও বলা হচ্ছে, ফিলিস্তিনে যে মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে তার প্রধান কারণ সহায়তা সংস্থাগুলোকে ঠিক মতো কাজ করতে না দেয়া। যদিও হতভাগ্য ফিলিস্তিনিরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক আইন-আদালত দিয়ে নেতানিয়াহুকে আটকানো যাবে না।
ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের একজন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এমন একটি রায় দিতে যাচ্ছে তা আগেই জানতাম। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। এরমধ্যে নেতানিয়াহু লেবানন ও গাজার বিষয়ে তার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলেছেন। যখন নেতানিয়াহুর কাজ শেষ, তখন এই রায় দেয়া হল। এ রায় কখনোই কার্যকর হবে না কারণ আমেরিকা ইসরাইলকে রক্ষা করবে। তারা চাইলে যেখানে খুশি ভেটো দিতে পারে। ইসরাইল তার কুকর্মের শাস্তি পাবে না।’
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রায়ের পর ধীরে ধীরে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন বিশ্বনেতারা। আদালতের রায় সাবধানতার সাথে অনুধাবনের আগ্রহ প্রকাশ করলেও নেতানিয়াহুর জার্মানি সফরের আগ পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হবে না বলে সাফ জানিয়েছে জার্মান সরকার।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীকে নিজ দেশে আমন্ত্রণ জানানোর ঘোষণা হাঙ্গেরির রাষ্ট্রপ্রধান ভিক্টর অরবানের। আর যুদ্ধবিরতির প্রশ্নে জাতিসংঘে উত্থাপিত প্রস্তাবে ভেটো দেয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছে চীনের পররাষ্ট্র দপ্তর।