হামলা-বিক্ষোভে অগ্নিগর্ভ ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মনিপুর। জিবরাম জেলায় কুকি বিদ্রোহীদের ১১ নভেম্বরের হামলা এবং নারী শিশুদের অপহরণের ঘটনায় শুরু হওয়া অস্থিরতা ক্ষোভের আগুনে রূপ নেয় অপহৃতদের মরদেহ উদ্ধারের পর।
বাসিন্দাদের একজন বলেন, ‘আমরা প্রচণ্ড হতাশ। নারী আর শিশুদের হত্যার চেয়ে মর্মান্তিক খবর আর কিছু হতেই পারে না। এটা সন্ত্রাসী হামলা, অপরাধীদের কাজ, এসব মানবতাবিরোধী অপরাধ, সকল ধর্মের বিরোধী। প্রধানমন্ত্রী মোদিকে এ বিষয়ে নীরবতা ভাঙতেই হবে।’
সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই সম্প্রদায় আর কুকি আদিবাসীদের সংঘাতে বিভক্তি দেখা দিয়েছে পুরো রাজ্যে। সাধারণ শ্রেণিভুক্ত মেইতেইরা কুকিদের মতো সুনির্দিষ্ট নৃগোষ্ঠী হিসেবে অন্তর্ভুক্তি চায়। যেখানে ভারতের মিজোরাম আর প্রতিবেশি মিয়ানমারের চিন প্রদেশের সাথে জাতিগত সম্পর্কভুক্ত কুকিরা চায় মনিপুর থেকে বের হয়ে আলাদা প্রশাসন।
এসব নিয়েই বিরোধের জেরে এর আগের সপ্তাহে এক মেইতেই নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা এবং ক্ষেতে কাজ করার সময় পাহাড় থেকে গুলি করে আরও এক মেইতেই নারীকে হত্যার অভিযোগ ওঠে কুকি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে। সবমিলিয়ে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে মেইতেই নারীদের।
বাসিন্দাদের আরেকজন বলেন, ‘ঘর থেকে তিন নারী আর তিন শিশুসহ ছয়জনকে কুকি সন্ত্রাসীরা উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেছে। এ ঘটনায় আমরা শোকাহত। বুঝতে পারছি না যে সন্ত্রাসীরা মানুষ নাকি জানোয়ার।’
এক বছরের বেশি সময় ধরে অস্থির ৩২ লাখ বাসিন্দার মনিপুর। মেইতেই অধ্যুষিত রাজ্যটির পার্বত্য অঞ্চলে আধিপত্য ২০টির বেশি নৃগোষ্ঠীর, যারা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকেই সমন্বিতভাবে পরিচিত কুকি হিসেবে। রাজ্যের সরকারি চাকরি ও শিক্ষায় সংখ্যালঘু কুকিদের জন্য নির্ধারিত কোটা ব্যবস্থা আর বিশেষ অর্থনৈতিক সুবিধার আওতায় মেইতেই সম্প্রদায়কেও আনা যায় কিনা, তা ভেবে দেখতে রাজ্য সরকারকে আদালতের নির্দেশের প্রেক্ষিতে ক্ষিপ্ত কুকিরা। এর প্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের মে মাস থেকে সংঘাতে রাজ্যটিতে প্রাণ গেছে কমপক্ষে আড়াইশ' মানুষের, বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ।
এরই ধারাবাহিকতায় জিবরামে হামলার প্রেক্ষিতে নিরাপত্তা বাহিনীর পাল্টা অভিযানে ১০ কুকি বিদ্রোহী নিহত হয় গেল সপ্তাহে। প্রতিবেশি আসাম রাজ্য থেকে মনিপুরে গিয়ে তারা হামলা চালিয়েছিল বলে জানায় প্রশাসন। ফলে উত্তাপ ছড়িয়েছে আসামেও। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে আছে আসামের নিরাপত্তা বাহিনী।
ভারতের আসামের কাচার এসপি নুমাল মাহাত্তা বলেন, ‘যত মরদেহ ছিল, বিভিন্ন এলাকায় যার যার পরিবারের কাছে সবার মরদেহ বিমানের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। মনিপুরের পুলিশও ছিল আমাদের সাথে। সবাইকে আমরা জানিয়ে দিয়েছি যে যাই হোক না কেন, তা প্রতিবেশী রাজ্যের বিষয়। তাদের কোনো বিষয়েই নিজেদের রাজ্যে আমরা আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে দেবো না।’
পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত ১০ কুকি বিদ্রোহীকে গ্রাম স্বেচ্ছাসেবক আখ্যা দিয়ে রাজ্যজুড়ে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় শাটডাউনও পালন করেছে কুকিরা। অন্যদিকে কুকি বিদ্রোহীদের হামলায় এক সপ্তাহে কমপক্ষে আটজন বেসামরিক মানুষ নিহতের ঘটনায় ক্ষোভ সীমা ছাড়িয়েছে মেইতেই সম্প্রদায়ের।
এমন পরিস্থিতিতেই স্থানীয় সময় শনিবার (১৬ নভেম্বর) সন্ধ্যায় মনিপুর মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে হামলার চেষ্টা এবং রাজ্যের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রীর বাসভবন অবরোধ করা হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে নিরাপত্তা বাহিনী।
রাজ্যের পাঁচ জেলার ছয়টি থানায় বিশেষ ক্ষমতাবলে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলে আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। দোষীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়ার এবং থানা থেকে সেনা প্রত্যাহারের দাবি বিক্ষুব্ধদের।
বিক্ষুব্ধদের একজন বলেন, ‘ওদের শাস্তি দিতে হবে। যতক্ষণ না শাস্তি দেয়া হবে, ততক্ষণ আমরা বিক্ষোভ করে যাবো।’
সহিংসতা ঠেকাতে প্রাদেশিক রাজধানী ইমফালের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল, বিষ্ণুপুর, থুবাল আর কাকচিংয়ে অনির্দিষ্টকালের কারফিউ জারি করেছে প্রশাসন। মোট সাত জেলায় বিচ্ছিন্ন আছে ইন্টারনেট সংযোগ।