অর্থনীতি
0

সমতা তৈরিতে জাতীয় অর্থনীতিতে ভাসমান অর্থনীতির অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন

অর্থের অনানুষ্ঠানিক হাতবদলের প্রায় ৮০ শতাংশ জিডিপির বাইরে। যার বড় অংশই ভাসমান অর্থনীতি। ১০, ৫০ বা ১০০ জন মিলে জনসংখ্যার বড় একটি অংশের এই আর্থিক হাতবদলে সৃষ্টি হয় কর্মসংস্থান। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এসব সঞ্চয় বিনিয়োগ হয় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের মতো মানবশক্তির উন্নয়নে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা জ্ঞান ও সচেতনতা ক্ষুদ্র থেকে জাতীয় অর্থনীতিকে পাল্টে দিয়ে গড়তে পারে অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতি। পরিবর্তন আনতে পারে জাতীয় সূচকে।

ঢাকা শহরে প্রতিদিন মানুষ আসছে। সবার সামনে এগোবার স্বপ্ন, কারো পেছনে হটবার জায়গা নেই। দুই কোটি মানুষের শহরে পরিবার বেশি, স্বজন কম। তেমনি হাত অনেক, মুঠোয় জড়াবার বন্ধু কম।

এই শহরের একজন দোকানদার ইব্রাহীম। তার নিজের দোকান আছে। এর বাইরে তিনি হেঁটে হেঁটে মানুষকে একত্রিত করেন।

বাড়ি-বাড়ি গিয়ে কিছু টাকার জমা নেন অনেকের কাছে। তেমনি একজন লাবণী আক্তার। তিনি ১০০ টাকা করে জমা রাখেন ইব্রাহীমের কাছে।

লাবণীর বাড়ি থেকে বের হয়ে ইব্রাহীম যায় পাশের বস্তির চায়ের দোকানে। একটা ঋণ আছে, সেই ঋণের কিছু টাকা পরিশোধ করবেন চা দোকানি।

চায়ের দোকানি ঋণ পরিশোধ করেন ইব্রাহীমের কাছে। ছবি: এখন টিভি

শহরের বস্তিগুলোর ঘনবসতিতে মুখ খুঁজলে সবাই অপরিচিত। বিভিন্ন গন্তব্য থেকে এসেছে তারা। প্রথমে মাথা আড়ালের জায়গা তারপর চাই কাজ। হাত না থাকলে এই শহরে কাজ পাওয়া এত সহজ নয়। না দিন মজুরের কাজ পেতে, না রিকশার জোগান।

নিম্নআয়ের একজন বলেন, 'আমরা দুইজন আছি এক জায়গা থেকে, আর অন্য একজন আলাদা। এজন আছে মানিকগঞ্জ থেকে আর আমরা দুইজন আছি বরিশাল থেকে। যখন আমাদের দরকার হয় তখন তাদের ফোন দেই, তারা চলে আসে।'

নিজের কিছু করতে প্রয়োজন অর্থের যোগান। টিকে থাকতে একটা ভ্যান গাড়ি দু'টি ফলের জোগান করতে হয়। তার জন্যও প্রয়োজন হয় হাজার খানেক টাকা। ছোটখাট উদ্যোগে ব্যক্তিগত টাকা ধার মেলে না। ব্যাংকের ফর্মূলার বাইরে এসব মানুষ। ফলে বিচ্ছিন্ন মানুষদের একতা একমাত্র ভরসা।

দোকানদার ইব্রাহীম বলেন, 'যারা ভ্যানগাড়িতে ফল বিক্রি করে। তরমুজ, আম কলা বিক্রি করে তাদেরও ঋণ দেই। আবার দেখা যায় গেঞ্জি বা কাপড় ভ্যানে বসে বিক্রি করে তাদেরও দিচ্ছি।'

ব্যক্তির প্রয়োজন আর প্রচেষ্টার পালে হাওয়া দিতে এক লক্ষ্যে সবার অংশীদারিত্বে এখানেও যৌথ সম্মিলন থেকে গড়ে উঠে সমিতি।

একজন সমিতির উদ্যোক্তা বলেন, 'আমার এই সমিতিতে ১২০ জন সদস্য আছে। তাদের জন্য আমার দুইজন কর্মী আছে। আমরা তো বহু টাকা নিয়ে ইনভেস্ট করে ব্যবসা করছি না। আমরা সঞ্চয়ের ওপর নির্ভর করে এটা করি। ১০ জনের থেকে নিয়ে তো একজনকে দিতে হয়।'

লাবণী আক্তার, আপাদমস্তক গৃহিণী। সকালের রান্নাবান্না, বাচ্চাদের তৈরি করা, স্কুলে পাঠান তারপর স্বামীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাওয়া।

কারণ, চাহিদার বাস্তবায়নে প্রয়োজন পূরণের আকাঙ্ক্ষা ও সক্ষমতা। সক্ষমতা না থাকলে সন্তুষ্টির পাখা ডানা মেলে না। তাই কিছুটা সচ্ছলতার চাহিদা জীবনের সমস্ত উপযোগের কারণ। এখন লাবণী বেগম শুধু ঋণ নয়, ঋণ ফিরিয়ে দিয়ে, এখন কিছুটা সঞ্চয়ও করেন।

গৃহিণী লাবণী আক্তার বাড়িতে কাজ করছেন। ছবি: এখন টিভি

লাবণী বলেন, 'আমার ছেলের যখন তিন-চার বছর বয়স হয়, তখন দেখি যে ছেলেকে কিছু দিতে পারি না, নিজেও কিছু নিতে পারি না। তখন মনে হয়েছে পাশাপাশি আমার কিছু করা দরকার। তার পাশে আমার দাঁড়ানো দরকার।'

ছোট ছোট ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার প্রবৃদ্ধি খরচ হয় লাবণী বেগমের ছেলেমেয়ের পড়াশুনা, খাদ্য আর একটি নিরাপদ বাসস্থানের মতো অধিকার নিশ্চিতে।

জাতিসংঘের গবেষণা বলছে, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নারীরা তাদের আয়ের সিংহভাগ খরচ করেন পরিবারের শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিতে। লাবণী বেগমও সেই কাজটিই করেন।

কিন্তু প্রায় ৮০ শতাংশের এই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে অর্থের এই হাতবদল জিডিপির বাইরে। আর যেখানে নারীর অংশগ্রহণ আরও বেশি আড়ালে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, 'যারা শ্রমে নিয়োজিত আছেন, তারা কিন্তু এই খাতেই নিয়োজিত আছে। কাজেই এ খাত কিন্তু আমাদের নিয়মিত জিডিপির বাইরে থাকছে। আর এখানে তথ্য বলছে নারীর অংশগ্রহণ ৩৬ থেকে ৩৮ শতাংশ। অর্থাৎ অর্ধেকেরও কম। তার মানে নারীরা এতোটাই কম উৎপাদন কাজে নিয়োজিত? বাস্তবে কিন্তু তা নয়।'

তবে সমিতিতে মানুষের ঋণ নেয়ার দিকেই ঝোঁক বেশি। অনেকেই ঋণ নিয়ে পূর্বের ধারদেনা শোধ করেন। ফলে চক্রাকার ঋণের চাকার ঘুরতে থাকেন গ্রহীতারা। এখানে ইতিবাচক-নেতিবাচক দু'টিই দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান। তার কারণ অর্থের ব্যবস্থাপনা জ্ঞান বা ইকোনমিক লিটেরেসি যে অজ্ঞতার প্রভাব প্রাতিষ্ঠানিক আনুষ্ঠানিক ও জাতীয় অর্থনীতিতেও আছে।

বিআইবিএম'র অধ্যাপক শাহ্ মো. আহসান হাবিব বলেন, 'বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা আমি বলবো একেবারেই ভালো না। এবং এটা একটা জায়গা যেখানে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনতে পারলে ব্যাংকের পাশাপাশি স্টক মার্কেট ডেভেলপ করবে। আর এটা হলে আর্থিক খাতের সাস্টেইন অ্যাবেলিটি বাড়বে। ব্যাংকের জন্যই কিন্তু ওইটার উন্নতি করা দরকার। ফলে বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যাংকেরও কাজ করছে, নন ব্যাংকেরও কাজ করছে, স্টক মার্কেটেরও কাজ করছে।'

বিশ্লেষকরা বলেন, সমাজে সমতা তৈরিতেও ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র অর্থনীতিকে জাতীয় অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

এসএস

এই সম্পর্কিত অন্যান্য খবর