কাস্তের প্রতিটি টানে প্রশস্ত হয় আবজাল মিয়ার জীবিকা। তার বাড়ি গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরে হলেও দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কামলা দিতে এসেছেন শরিয়তপুরের কাজিরহাট এলাকায়। হাড়ভাঙা খাটুনির পর পরিবারের মুখে আহার যোগাতে যেন হিমশিম অবস্থা তার। আয়ের চেয়ে ব্যয়ের খাতা ভারী হওয়ায় দীর্ঘশ্বাস তার।
আবজাল মিয়ার সঙ্গে পাটের জমিতে কাজ করছেন অন্যান্য কৃষক। ছবি: এখন টিভি
আবজাল মিয়া বলেন, 'যে বিড়ি আগে খাইতাম ১৪ বা ১৫ টাকায়, এখন সেই বিড়ি ২৫ টাকায় খাইতে হয়। চাউল কিনতাম ৩০ টাকায় সেটা কেনা লাগে ৭০ টাকায়। না পারি মাছ খাইতে, না পারি সপ্তাহে একদিন গোস্ট খাইতে। খুব কষ্ট করে চলতে হয়।'
সবুজের বীজ বোনা কৃষকের এমন সরল বাক্য কতটা সহজ? যে জমিনেই আবাদ হয় রুটি-রুজির জোগান, বিগত সরকারের ১৫ বছরে সেখানেও টান পড়েছে অনেক। বাধ্য হয়ে তাই আফজাল মিয়ার মতো ঋণের ভারে বন্দি অন্য কৃষকরাও। মূল্যস্ফীতি তাদের নাজেহাল করলেও শেখ হাসিনার অযাচিত ঋণের চাপে ঘাম আর শ্রমের মাত্রা বাড়িয়েছে দ্বিগুণ।
একজন সবজি চাষি বলেন, 'তার, কাগজ, সুতা কিনতে হয়। সবজির জাংলা দেয়ার জন্য। সবকিছুর দাম দ্বিগুণ। পোলাপান নিয়ে ঠিকমতো খাইতে পারি না। দেখা যায় ওষুধ কিনতে গেলে দ্বিগুণ টাকা দিয়ে কিনতে হয়।'
তাহলে সরকারের অতিরিক্ত ঋণ নির্ভরতাই কি দাম বাড়ার মুখ্য কারণ? একদিকে দাম বাড়ানো অন্যদিকে ঋণের সুদ হার কিংবা পরোক্ষভাবে অর্থ আদায়। তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশি-বিদেশি ঋণের প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে অর্থ বিভাগ। সেই হিসেবে ঋণের স্থিতি দেখানো হয় ১৬ লাখ ৫৯ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা।
শেষ তিন বছরে বাংলাদেশের ঋণের চিত্র।
তিন মাস পর পর দেশি-বিদেশি ঋণের হিসাব হালনাগাদ করার নিয়ম থাকলেও সে অংক প্রকাশ না করার আগেই দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় শেখ হাসিনা সরকার। তবে অর্থ বিভাগ বলছে, চলতি বছরের জুন শেষে দেশি-বিদেশি ঋণ স্থিতি দাঁড়াবে প্রায় ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। আর মাথাপিছু ঋণ দাঁড়াবে ১ লাখ ৮ হাজার ১০৮ টাকা।
কীভাবে এত ঋণে জর্জরিত হলো আওয়ামী লীগ সরকার? সংশ্লিষ্ট খাতের বিশ্লেষকদের মতে, সাবেক সরকারের যথাযথ ঋণ ব্যবস্থাপনা না থাকায় দর-কষাকষি ও বাছবিচারহীনভাবে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে নেয়া হয়েছে ঋণ। যার প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক শহীদুল জাহীদ বলেন, 'তারা দেখাতে চেয়েছিল যে আমরা খুব উন্নত দেশে পরিণত হতে যাচ্ছি। কিন্তু এখানে যে আদতে দাঁড়িয়েছে, এউ অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাওয়া বা না পাওয়ার সাথে জড়িত ছিল হচ্ছে আমাদের কষ্ট অব ফান্ড। যখনই আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেতে যাচ্ছি তখনই আমাদের কষ্ট অব ফান্ড বেড়ে যাচ্ছে। সুতরাং সরকার আসলে সেই মুহূর্তে অদূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছে। এবং তারা সস্তা রাজনৈতিক বেনিফিট পাওয়ার জন্য এ ধরনের এককটা সিথ তৈরি করেছিল।'
সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশু থেকে ব্যক্তিগত ঋণে জর্জরিত মানুষেরাও পড়েছেন অপ্রত্যাশিত এই ঋণের কবলে। মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যক্তিগত দেনা পরিশোধের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় দেনার ভার এসে পড়েছে তাদের নিত্যদিনের বাজার সদায়ে।
ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে জাল টেনে মাছ ধরছেন একজন জেলে। ছবি: এখন টিভি
নিম্নবিত্ত পরিবারের একজন ব্যক্তি বলেন, 'আমরা গরীব মানুষ, আমাদের প্রতিদিন আলু প্রয়োজন হয় দেড় থেকে দুই কেজি। কিন্তু, এক কেজিও কেনার টাকা আমাদের হয় না। আমার পোলা ঘরে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে, এখনও ডাক্তার দেখাতে পারছি না।'
এ ভার ছুঁয়ে গেছে সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে সব শ্রেণীপেশার মানুষকে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিক্ষা জীবনসহ জীবন যাত্রার মানেও।
একজন শিক্ষার্থী বলেন, 'দেখো যাচ্ছে যে আগে ২০ টাকা দিয়ে একটা খাতা পাওয়া যেতো, এখন সেই একই খাতা ৩৫ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। আগে একটা কলম পাঁচ টাকা দিয়ে কিনতাম এখন সেটা সাত টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। যদি বলি এটা সরকারি রেট, তখন দেখা যায় সেটা সরকার নিচ্ছে কিন্তু পে করছি আমরা।'
ঋণের এই বোঝা থেকে সহজেই মুক্তি মিলছে না বলে বলছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রকল্প নির্বাচনে সচেতন না হলে এ ঋণ বয়ে বেড়াতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় এটা যেন সুশাসন সঙ্গে সাশ্রয়ীভাবে হয়, সময়মতো শেষ করা যায় সেদিকেও আমাদের নজর দিতে হবে। এটা যদি আমরা না করি তাহলে আমাদের দেশের ঋণের দায়ভার বাড়বে, মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ বাড়বে। এবং আমরা এই ঋণ পরিশোধের দায়ভার পরবর্তী প্রজন্মের ঘাড়ে আমরা দিয়ে দেবো। এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।'
এভাবেই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে হাঁটছেন সারাদেশের ১৬ কোটি ৯৮ লাখ মানুষ। আওয়ামী লীগ সরকার উন্নয়নের নামে দেশ-বিদেশ থেকে বাছ-বিচারহীনভাবে ঋণ নেয়ার ফলে অস্বাভাবিক ঋণের বোঝা ঘাড়ে চেপেছে বলে বলছেন সাধারণ মানুষ। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি দেশজ উৎপাদন বাড়াতে পারলে ঋণের চাপ যেমন কমবে তেমনি স্বস্তি ফিরবে সাধারণ মানুষের মাঝে।