দশ বছরে নারী অভিবাসন কমেছে ৬৬ শতাংশ; নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো ভবন, ভুক্তভোগী নারী, অভিবাসনপ্রত্যাশী নারী | ছবি: এখন টিভি
0

নানা নির্যাতন ও দক্ষতার অভাবে গেল এক দশকে নারী অভিবাসীর পরিমাণ কমেছে ৬৬ শতাংশ। অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমস্যা সমাধানে লেবার উইংগুলোর রয়েছে সদিচ্ছার অভাব। সেই সঙ্গে শ্রমবাজার নারীবান্ধব করার পাশাপাশি নিরাপদ অভিবাসনে সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

মূলত বাংলাদেশের নারী কর্মীদের অভিবাসন মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রীক। ভিনদেশি মুদ্রার যোগানে অগ্রদূত প্রবাসীরা। পরিবার আর নিজের ভবিষ্যতকে একটুখানি উজ্জ্বল করতে তারা পাড়ি জমান বিদেশ-বিভূঁইয়ে। রেমিট্যান্স যোগানের এ যুদ্ধে পুরুষদের পাশে সামিল নারীরাও।

তবে বিদেশের মাটিতে সবার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় না। ভিন্ন বাস্তবতার মুখে অনেকেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে শূন্য হাতে ফিরতে হয়।

তেমনই একজন মানিকগঞ্জের রেবা আক্তার। ভাগ্য বদলে সৌদিআরবে পাড়ি জমালেও দেড় বছরের মাথায় ফিরে আসতে বাধ্য হন। যে তিক্ত অভিজ্ঞতার সঙ্গী হয়েছেন, তা নিয়ে আর কোনো দেশেই যেতে চান না তিনি।

রেবা আক্তার বলেন, ‘মরধর করতো, গায়ে হাত তুলতো। আমি অনেকবার অফিসে জানাই, আমার স্বামী এলাকা থেকে অনেক লোকজন নিয়ে অফিসে যায়, তারা শুধু বলে এনে দিচ্ছি, এরকম বলে বলে ডেট দেয়। পরে শেষ এক বছর পাঁচ মাস আমি অনেক কষ্টে কাটাইছি। নারী পুরুষ যেই যাক তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে যাক। গিয়ে আমার মতো যেন কেউ বিপদে না পরে।’

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো’র সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান বলছে, গেল এক দশকে নারী অভিবাসীর সংখ্যা কমেছে ৬৬ শতাংশ। গেল ১০ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৬ সালে নারী অভিবাসীর সংখ্যা ছিল এক লাখের ওপর। করোনাকালে সে যাত্রায় অনেকটা ভাটা পড়ে। সবশেষ ২০২৪ সালে বিদেশে গেছে ৬১ হাজার নারী কর্মী। আর চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত সে সংখ্যা ২৪ হাজারের কিছু বেশি।

আরও পড়ুন:

নারী অভিবাসন কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে উঠে আসছে নানা নির্যাতনের করুণ কাহিনী আর দক্ষতার অভাব।

অভিবাসনের অপেক্ষায় থাকা নারীদের মধ্যে একজন বলেন, ‘যারা দালালের মাধ্যমে যায়, তারা ওদের ফাঁদে পড়ে গেলে ওখানে এ কাজ হয়। যারা হাউজ ভিসায় যায় তাদের ক্ষেতে এরকম শোনা যায় যে স্যালারি ঠিকমতো হয় না, টর্চার করে। আমরা যাচাই-বাছাই করেই যাচ্ছি।’

অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন সংস্থা-ওকাপ এর গবেষণা বলছে, নারী অভিবাসীদের প্রায় ৯৪ শতাংশই নানাভাবে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। ৭৯ শতাংশ ঠিকমতো বেতন পান না, আর নিয়মিত খাবারের অভাবে ভোগেন ৮০ শতাংশ নারী।

বিশ্লেষকরা বলছেন, পর্যাপ্ত দক্ষ ও প্রশিক্ষিত না হওয়ায় বিদেশে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশের নারী কর্মীরা। নারী অভিবাসনের সমস্যা সমাধানে লেবার উইংগুলোর সদিচ্ছার অভাব আছে বলেও জানান তারা।

অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম-ওকাপের চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘নারীরা নির্যাতিত হয় বিদেশে গিয়ে কর্মক্ষেত্রে, তার কারণে কিন্তু একটা নেগেটিভ ইম্প্রেশন আমাদের মধ্যে আছে। সৌদি আরবসহ আরবের বিভিন্ন দেশে যে কমপ্লেইন ম্যাকানিজম আছে, বিচার পাওয়ার যে স্ট্রাকচারগুলো আছে সেখানে তাদের হেল্প করা, তাদের সেগুলো পাইয়ে দেয়ার যে ব্যবস্থা আছে সেগুলো কিন্তু তারা সেখানে পায়নি। বরং এ কারণে তাদের ফেরত আসতে হয়েছে।’

আরও পড়ুন:

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীদের জন্য শ্রমবাজার আশানুরূপ সম্প্রসারণ হয়নি। মোট জনশক্তির ১০-১২ শতাংশ নারী বিদেশে গেলেও ক্রমান্বয়ে তা কমছে। এমন প্রেক্ষাপটে নারী অভিবাসন নিরাপদ ও আধুনিকীকরণ করতে জনশক্তি রপ্তানির প্রস্তাবিত চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি তাদের।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর তন্ময় বলেন, ‘কিছুটা হলেও চাহিদা কমে আসছে আমাদের নারীদের। যেখানে চাহিদা আছে সেটা হচ্ছে যে, তাদের কিছুটা শোষণ করা যায়। অর্থাৎ তাদের কম বেতনে নিয়োগ করা যায় কারণ তারা লেখাপড়া জানে না, কিছুই জানে না। শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হচ্ছে। যেহেতু বাড়ির ভেতরে তারা কাজ করছে, জবাবদিহিতা সেখানে থাকছে না। এমনকি সেখানকার আইন অনুযায়ীও কোনো জবাববদিহিতার জায়গা তৈরি করা যাচ্ছে না। নতুন কোনো চুক্তি হয়নি। দেখা যাচ্ছে তুলনামূলকভাবে নারীদের যাওয়ার ক্ষেত্রে হারটা কমে আসছে। চুক্তির একটা স্ট্যান্ডার্ড ফরম্যাট তৈরি করে নেয়া যেন, নারীরা যেখানেই যাবেন সেখানে বেসিক কিছু জিনিস চুক্তির মধ্যে থাকবে।’

নারীর নিরাপদ অভিবাসন নিয়ে কি ভাবছে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো? জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক ক্যামেরার সামনে কথা না বললেও জানান, নিরাপদ অভিবাসনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা।

এসএস