দেশে এখন
বিশেষ প্রতিবেদন
0

'সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়নে গণপরিষদ গঠন করতে হবে'

একনায়কতন্ত্র রুখতে সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের সুপারিশ করবে সংবিধান ও নির্বাচন সংস্কার কমিশন। থাকতে পারে দ্বিকক্ষ আইনসভা, প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস ও আনুপাতিক নির্বাচনের প্রস্তাব। কিন্তু রাজনৈতিক দল, সরকার ও গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রদের মধ্যে নির্বাচন আর সংস্কার নিয়ে যে টানাপড়েন তাতে এসব সংস্কার প্রস্তাবের ভবিষ্যৎ কী? রাজনীতি বিশ্লেষক বলছেন, প্রস্তাব বাস্তবায়নে গণপরিষদ গঠন করতে হবে। রাজনৈতিক দলসহ পক্ষগুলো ধৈর্য না ধরলে গভীরে সংকট পড়বে দেশ।

বহু রক্তের পর, এমন নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থান নতুন আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে পরিবর্তনের। প্রশ্ন উঠেছে, আইন, সরকার কিংবা বিচার ব্যবস্থা নিয়ে। বলা হচ্ছে, সেই আগের মতই কি চলবে বাংলাদেশ, যে পদ্ধতি ক্ষমতাকে স্বৈরাচারের রূপ দেয় ।

সংবিধানের চতুর্থ ভাগের প্রথম পরিচ্ছেদে দেশের প্রধান ব্যক্তি, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এর ৪৮ অনুচ্ছেদের তিন ধারায় বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী আর প্রধান বিচারপতি নিয়োগ বাদে রাষ্ট্রপতি তার অন্য সকল দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী পালন করবেন। তবে শর্ত থাকে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোনো পরামর্শ দিয়েছেন কি না এবং করে থাকলে কী পরামর্শ, কোনো আদালত সেই সম্পর্কে কোনো প্রশ্নের তদন্ত করতে পারবেন না।

অপরদিকে এর পরের, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদেই আছে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার দায়িত্বের কথা। ৫৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী সময়ে সময়ে যেভাবে মনে করবেন, সেভাবেই অন্যান্য মন্ত্রী নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন হবে, যারাই মূলত সরকার পরিচালনা করেন। কিন্তু এই অনুচ্ছেদের চার নম্বর ধারায়ই আবার বলা হচ্ছে, সরকারের সকল নির্বাহী ব্যবস্থা রাষ্ট্রপতির নামে গৃহীত হয়েছে বলে প্রকাশ করা হবে।

ক্ষমতার রাজনীতিতে আলংকারিক পদ আর আক্ষরিক পদের এমন সাংবিধানিক বৈষম্যই যে একেকজন একনায়ক তৈরির জন্য যথেষ্ট তা স্বীকার করেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু প্রশ্ন হলো এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, 'যদি আমরা যথাযথভাবে সংবিধান সংস্কার করতে পারি, রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যের মাধ্যমে সংবিধানে এমনসব পদ, যেসমস্ত পদ ব্যক্তিতান্ত্রিক এখন একতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠা করে সেগুলোর পথ যদি বন্ধ করা যায় তাহলে আরেকজন শেখ হাসিনা তৈরি হওয়ার বা আরেকজন স্বৈরাচারী হওয়ার পথ বন্ধ করা সম্ভব।'

ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে আর যাতে ফ্যাসিবাদ তৈরি না হয়, এর জন্য যে সংস্কার কমিশনগুলো গঠন করা হয়েছে, সবার সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদন আর প্রস্তাব তৈরির জন্য তাদের সময়ে দেয়া হয়েছিল এই ডিসেম্বর পর্যন্তই। এ কয় দিনে তারা বড় দাগে যে পরিবর্তন প্রস্তাবের কথা বলছে তার মধ্যে নির্বাচন ও সংবিধান অন্যতম।

দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা অবশ্য সংবিধান সংস্কার কমিশনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই কমিশন বলছে, নাগরিক অধিকারের বিষয়গুলোকে আরও সহজ ও শক্তভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে তারা এমন প্রস্তাব দেবেন, যাতে প্রধানমন্ত্রীসহ শীর্ষ ব্যক্তিরা আর একক কর্তৃত্ববাদী না হয়ে উঠতে পারেন। এর জন্য রাষ্ট্রপতি ও সংসদের সঙ্গে ক্ষমতার ভারসাম্য, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত ও বিকেন্দ্রীকরণ ও দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব থাকবে।

অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, 'কীভাবে হবে এটা উনারা বের করুক, কিন্তু কী করতে হবে এটা আমরা বলতে চাচ্ছি। আমাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কী করতে হবে তার জন্য। উচ্চকক্ষের ক্ষেত্রে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব তৈরি করা যায় কি না। এটা কিন্তু তিনটা মডেলের কোথাও নেই। ফলে এটাও একটা বিবেচ্য বিষয়। সেজন্য আমাদের সামনে চারটা মডেল আছে।'

নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সদস্য মীর নাদিয়া নিভিন বলছেন, প্রস্তাবে তারা নির্বাচন কমিশনের প্রতি যাতে মানুষের আস্থা ফিরে আসে সে বিষয়গুলোর ওপরই জোর দেবেন। এর জন্য প্রার্থী হলফনামা আরও স্পষ্ট এবং আরও বিশ্লেষণের সুযোগ রাখা, না ভোট, নতুন করে সীমানা নির্ধারণ অন্যতম। তিনি বলছেন, তারা নির্বাচনী অপরাধের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা যেন বরাবরের মতো পাড় পেয়ে যেতে না পারেন, এর জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠনসহ নির্বাচনী অভিযোগ ও বিচার ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার প্রস্তাব দেবেন। তবে এখানে নতুন চমক হিসেবে থাকছে, সংরক্ষিত নারী আসন উঠিয়ে দিয়ে, ঘূর্ণায়মান নারী সংসদ সদস্য নির্বাচন পদ্ধতি। কিন্তু ব্যাপারটি আসলে কী?

নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সদস্য মীর নাদিয়া নিভিন বলেন, 'আমরা চিন্তা করছি যে সংসদে ২৫ শতাংশ সিটে সরাসরি ইলেকটেড হয়ে নারীরা আসবে। ৪০০টি সিটের মধ্যে লটারির মাধ্যমে যেকোনো ১০০টি সিট পছন্দ করা হবে। ১০০টি সিটের মধ্যে প্রতিটি রাজনৈতিক আসলে প্রতিটি রাজনৈতিক দল শুধু মহিলা প্রতিনিধি দিবেন।'

রাজনীতি বিশ্লেষক দিলারা চৌধুরীর কাছে এখন টিভির পক্ষ থেকে প্রশ্ন ছিল, এমন অবস্থায় সংস্কারের এসব প্রস্তাবের আসলে ভবিষ্যৎ কী?

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী বলেন, 'রাজনৈতিক দলে অধৈর্য হলে চলবে না। কারণ আমরা একটা সংকটে আছি। এবং অতীতে তাদের যেসমস্ত কার্যকলাপ তাতে জনগণের তাদের প্রতি সেরকম বিশ্বাস নেই, এই জিনিসও তাদের মাথায় রাখতে হবে। এবং অন্তর্বর্তী সরকারেরও একটা রোডম্যাপ দিতে হবে। একটা ফ্রেমওয়ার্কের সংস্কারগুলো এনে সংবিধান কেমন হবে এবং একটা নির্বাচন দিবে সেটা গণপরিষদের নির্বাচন হবে দুই বছরের জন্য। সেই গণপরিষদটা যেসমস্ত প্রস্তাবগুলো এসেছে এগুলো আলাপ আলোচনা সবকিছু করে একটা গণভোট দিয়ে দিবে।'

গণঅভ্যুত্থানের পর টালমাটাল পরিস্থিতি, প্রতিবেশি ও আন্তর্জাতিক সমস্যার প্রেক্ষাপটে এই বিশ্লেষক রাজনৈতিক ঐক্যের দিকেই বেশি জোর দিচ্ছেন। অপরদিকে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান, ওয়েবসাইট ও বিভিন্নভাবে লক্ষাধিক মানুষ ও রাজনৈতিক দলগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত পরামর্শ প্রদান, বেশি মানুষের সংস্কারের বিষয়ে মতামত প্রদান, পরিবর্তনের পক্ষে গণমানুষের সাড়া হিসেবে দেখছেন। এখন সংস্কারের প্রশ্নে বাস্তবিকই পক্ষগুলো কতটা একমত হয়, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে, কমিশনগুলোর প্রস্তাব জমা দেবার পর জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের বৈঠকের জন্য।

এসএস