দেশে এখন
0

একসময়ের সংগীত শিল্পী এখন বিক্রি করেন ইঁদুরের ওষুধ

একসময় বাবুলের বাজারে বড় হাট বসলেও এখন মৃতপ্রায়, কেবল লোকমুখে নাম জপে বেঁচে আছে বাজারের নামটুকু। এ জনপদে একসময় গারো জাতি, কোচ-বর্মনদের সংখ্যাই বেশি ছিল। কারণ, পুরো এলাকা ছিল জলাভূমি আর শাল-গজারিতে ঘেরা। পরবর্তীতে বনে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বসবাস আর বনখেকোদের দৌরাত্ম্যে বনভূমি বিলীন হওয়ায় আদিবাসীদের অনেকেই অন্যত্র চলে যায়। এখনও অস্তিত্বের জানান দিতে ৭০ থেকে ৮০ ঘর গারো আর ৫০ ঘর কোচ পরিবার টিকে আছে। কয়েকশ’ বছরের পুরনো বাবুলের বাজারে গেলে এখনও তাদের সরব উপস্থিতি তারই সাক্ষ্য দেয়।

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নের বাবুলের বাজারে বিকেলের দিকে বড়বিলার ছোট মাছ, স্থানীয়দের উৎপাদিত কিছু সবজি ছাড়া তেমন কিছুই মেলে না। পড়ন্ত বিকেলে একটা টং চায়ের দোকানে বসে মাত্র চায়ে চুমুক দেবো, এমন সময় হ্যন্ড মাইকে ভেসে আসছে মরমী গানের খুব পরিচিত সুর, ‘তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়...’

একটু এগোতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আহা, আমাদের আশুদা যে! ছোটবেলায় দেখতাম বিজয় দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি কিংবা উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কখনও হারমোনিয়াম, কখনও তবলা বা ঢোল বাজিয়ে নজরুল, রবীন্দ্র, আধুনিক ও লোকগীতি গাইতেন। আজও গাইছেন তিনি গলা ছেড়ে তবে কোন অনুষ্ঠানের মঞ্চে না, মাটিতেই বসে। তাঁর সামনে সাজানো রয়েছে ইঁদুর, তেলাপোকা, ছারপোকা মারার ওষুধ, প্রায় ১৫ বছর পর আশুদার সঙ্গে দেখা হলো।

তার পুরো নাম আশুতোষ মাইতী। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার শিবপুরে। পরিবারের ভাই-বোনরা যার যার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হলেও জন্মান্ধ আশুতোষ অভাব আর অনটনের মধ্যেই আছে। একসময় কীর্তন গাইতেন তিনি। আসরে গান করাসহ সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিখিয়ে যা আয় হতো তা দিয়ে পুরো পরিবারের খরচ চলতো। এখন বয়সের ভারে দাঁত পড়েছে, গলা ভেঙেছে, সুরও আর আগের মতো গলায় খেলে না। আর মোবাইলের যুগে এসে রোজগারেও টান পড়েছে, কিছুদিন হাট-বাজারে গান গেয়ে সংসার চললেও পরে মানুষের কাছে হাত পেতে চলেছেন। গত দুই বছর ধরে এখন ইঁদুর, পান্ডার মলম, চুলকানির ওষুধ বেচে পরিবার চালাচ্ছেন তিনি। দৈনিক গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা আয় হয়, অসুস্থ থাকলে তাও হয় না।

আক্ষেপ নিয়ে এই সংগীত শিল্পী বলেন, ‘অভাবের কারণে জীবনে কোন কিছুতেই পূর্ণতা পায় নাই। গানটাও ধরে রাখতে পারিনি, একসময় গান গাইতাম, গান ও বাদ্যযন্ত্র শিখাইতাম। পরে মোবাইল-ইন্টারনেটের যুগ আসায় আমার মতো অন্ধ মানুষের গান কেউ শুনে না। তাই বাধ্য হইয়া পথে নামছি। ইন্দুর মারার ওষুধ, পান্ডার মলম ও কৃমির ওষুধ বাজারে বাজারে বিক্রি করি। কোনদিন চাল-ডাল কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারি, কোনদিন তাও হয় না। আর ব্যবসার পুঁজিও নাই।’

আশুতোষ আরও বলেন, এই পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপ নাই আমার, তবে মাকে দেখবার আক্ষেপ আজীবনের রয়ে গেল। বাকী জীবনে দুটো ডাল-ভাত খেয়ে পরিবার নিয়ে কিছুটা সম্মান নিয়ে মরে যেতে পারলেই হলো। আমার ভাঙা ঘরে পানি পড়ে, সরকার ও বড়লোক যারা আছে তাদের কাছে একটা ঘর চাই। পোলাপানগুলা হাইস্কুলে পড়ে, লেখাপড়ার খরচ দিতে পারি না। কেউ যদি সহযোগিতা করতো তাহলে ব্যবসাও একটু বড় করতে পারতাম। হাট-বাজারে এখনও মানুষ আমারে শিল্পী হিসাবে চিনে, ভালোবেসে দশ-পাঁচ টাকা দেয়। যার দরকার পড়ে ওষুধও কেনে। তাই এভাবে আর কতদিন চলমু, পোলাপানের জন্য কিছুই রাইখা যেতে পারলাম না। সম্ভব হলে আমার জন্য কিছু কইরেন আপনারা।’

বাবুলের বাজারে আশুদার সঙ্গে এই ছিলো আমার শেষ কথা। একটা দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধারণ করে বাঁচার চেষ্টা করে এই শিল্পীরা। আশুতোষের মতো এমন অনেক হতদরিদ্র শিল্পী আমাদের দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের কেউ কেউ অবহেলা, অনাদর ও রোগ-শোকে ভুগছে।

শ্রমের হাটে তারাও একজন শিল্পী শ্রমিক। খুব অল্প সংখ্যক মানুষের খবরই সামনে আসে, অগোচরে থেকে যায় বহু আশুতোষের মতো শিল্পীর জীবনের গল্প। একসময়ের সংগীত শিল্পী আশুতোষ এখন ইঁদুরের ওষুধ বিক্রি করে, এই তার পরিচয়। হয়তো এমন পরিচয়ে একজন শিল্পী কোনদিন কোন কালেই বাঁচতে চায় না। মহান মে দিবসে পৃথিবীর মানবিক মানুষগুলো তার মতো এমন শিল্পীর পাশে এগিয়ে আসুক এমনটাই প্রত্যাশা সবার।