দেশে এখন
0

মশা নিধনে বিপুল অর্থ খরচেও সুফল মিলছে না

‘মশা মারতে কামান দাগা’ বাগধারাটি যেন ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের জন্য সত্যি হয়ে ধরা দিয়েছে। ক্ষুদ্র কীট মশা নিধনে অনেক টাকা খরচ করলেও ফলাফল শূন্য।

নগরবাসীর সঙ্গে ডেঙ্গু নিয়ে কথা বলতে বলতেই টের পেলাম, ঘিরে ধরেছে কিউলেক্স মশা। এই পরিস্থিতিই বলে দেয়, ঢাকা উত্তর সিটির আধুনিক এলাকা উত্তরায় কি পরিমাণ মশা রয়েছে। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে। বাসিন্দাদের অবস্থা জানতে কিছুদূর এগুতেই চোখে পড়ে একই দৃশ্যের। মশার যন্ত্রণায় বাইরে বসার জোঁ নেই। এমনকি বাসা-বাড়িতেও মশার দাপট। উত্তরের মতো ঢাকা দক্ষিণেও মশার কামড়ে অতিষ্ট নাগরিকরা। এতে মানুষের নিত্যদিনের কাজ ব্যাহত হচ্ছে।

তবে কি অকার্যকর সিটি কর্পোরেশনের মশা মারার ওষুধ? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মশার লার্ভা ও পূর্ণাঙ্গ মশা দমনে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ব্যবহার করে ম্যালাথিয়ন, টেমিফস, নোভালুরন নামক কীটনাশক। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ম্যালাথিয়ন ও ডেল্টামেথ্রিন কীটনাশক ব্যবহার করে।

মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে দুই সিটি করপোরেশন প্রায় ৬শ' কোটি ব্যয় করেছে। ওষুধ ছাড়াও মশা নিয়ন্ত্রণে ড্রেনে গাপ্পি মাছ, তেলাপিয়া মাছ ও ব্যাগ দিয়ে মশা মারার চেষ্টা চালিয়েছে দুই নগর অভিভাবক। কিন্তু কাজের কাজ হয় না, উল্টো প্রতি বাজেটেই যুক্ত হয় বাড়তি খরচ। আর খরচের খাতা লম্বা হয়।

নগরবাসী বলেন, ‘শীতকালে মশার উপদ্রব একটু কম ছিল। কিন্তু কিছুদিন মশার উপদ্রব বেড়েছে। মশার যন্ত্রণায় আমরা ঘরে-বাইরে সবখানে অতিষ্ঠ। কোনো কাজ করে শান্তি নেই। কীটনাশক স্প্রে করতে দেখি, কিন্তু মশার উৎপাত তো কমে না।’

২০১১ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন থেকে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ দুই ভাগে ভাগ হওয়ার পরে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত মশা মারতে প্রায় ১২শ' কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের খরচ ৫শ' কোটি এবং ঢাকা উত্তরের খরচ ৬শ' কোটি টাকার উপরে। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই খাতে ডিএনসিসি বরাদ্দ দিয়েছে ১২২ কোটি আর ডিএসসিসির বরাদ্দ ৪৭ কোটি টাকা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরে ডেঙ্গুতে ৮শ' ৬৮ জন মারা গেছেন। কিন্তু ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে প্রাণহানি দুই যুগের দ্বিগুণ। ডেঙ্গু প্রাণ নিয়েছে ১ হাজার ৭০৫ জনের। আর আক্রান্ত হয়েছেন রেকর্ড ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন।

সাধারণত জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশা বংশ বিস্তার করে। কিন্তু গেল বছরের এডিসের প্রজনন স্থলের পরিবর্তন হয়েছে বলে জানান গবেষকরা। সে সময় কংক্রিটের দেয়ালের ফাঁকেও এডিসের জন্মানোর প্রমাণ মিলেছে। ইতোমধ্যে এডিসের আঁতুরঘর বলে পরিচিত নির্মাণাধীন ভবন, বাসা-বাড়ির ছাদ ও অন্যান্য স্থানে অভিযান চালিয়েছে দুই সিটি। বিপুল জরিমানাও করা হয়েছে। তবুও নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডেঙ্গু। যেখানে পার্শবর্তী দেশ ভারতের কলকাতা শহর ডেঙ্গুমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল।

এর মধ্যে গেল বছর মশা নিধনে নতুন অস্ত্র বিটিআই আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় ডিএনসিসি। জৈবিক লার্ভাধ্বংসকারী এই ওষুধ ব্যবহারে সুফল মিলেছে বহির্বিশ্বে। কিন্তু আমদানির আগেই ধরা পড়ে নানান অনিয়ম। এতে মশা মারার শেষ আশাও মুখ থুবড়ে পড়ে।

মশা নিধনে সিটি কর্পোরেশন ব্যর্থ কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে উত্তরের মেয়র আবারও ভরসা রাখছেন বিটিআই ওষুধে। আর দক্ষিণের মেয়র দুষলেন পুরনো হাতিয়ার সমন্বয়হীনতাকে।

ডিএনসিসি’র মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘মশা নিধনে আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা আছে। আমরা আধুনিক ব্যবস্থায় মশা নিধনের চেষ্টা করছি। আর ডিএনসিসি এখন সরাসরি বিটিআই আমদানি করছে।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘আমরা আশা করছি, এবার মশার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবো।’

মেয়রের দাবি অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, ‘শুধু কীটনাশকে না ঝুঁকে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কিউলেক্স ও এডিস মশা নির্মূলে উদ্যোগী হতে হবে।’

এরই মধ্যে আসন্ন ডেঙ্গু মৌসুমে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের কয়েকটি জেলায় এডিস মশার প্রজনন বৃদ্ধি পাওয়ার পূর্বাভাস দিচ্ছেন কীটতত্ত্ববিদরা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের বর্ষা পরবর্তী জরিপেও এ বছর ডেঙ্গুর মারাত্বক আকার ধারণ করার আভাস মিলেছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ঘনত্ব পরীক্ষা করে তারা দেখেছে, অন্যান্য বছরের তুলনায় বর্ষা পরবর্তী এডিসের প্রজনন তিনগুণ বেশি।