১০ তলা বিশিষ্ট বাণিজ্যিক ও আবাসিক মিশ্র একটি ভবনে মূল সিঁড়ির বাইরেও আলাদা একটি সিঁড়ি রয়েছে। কিন্তু আদতে এটি যেন একটি গুদাম ঘর। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এখানকার মানুষ কিভাবে বের হবেন, তার চেয়ে বড়কথা এই ভবনের বিকল্প সিঁড়িটির পথ তৃতীয় তলায় আসলেই শেষ হয়ে যাবে।
পুরো রাজধানীতে এভাবেই এমন হাজার হাজার স্থাপনা গড়ে উঠেছে। অনেক ভবনে অতিরিক্ত সিঁড়ি বা ফায়ার এক্সিট পাওয়া যায়নি। কোনো কোনো ভবনে বিকল্প সিঁড়ি থাকলেও বের হওয়ার পথটি বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
মূলত একেকটি ভবনের ক্যাটাগরি অনুযায়ী, আলাদা আলাদা অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার বিধান রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের বিবেচনায় মোটাদাগে যে কয়টি কারণে অগ্নিনির্বাপণ ও বিকল্প সিঁড়ির ব্যবস্থা রাখতে হয়, তা হলো- আয়তন, মানুষের ঘনত্ব এবং ভবনটি বহুতল কিনা। প্রথম দুটি নিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও রাজউকের মধ্যে কোনো মতানৈক্য না থাকলেও বহুতল ভবনের সংজ্ঞা নিয়ে বিপত্তি আছে।
রাজধানীর মিরপুর এলাকার ৭ তলা বিশিষ্ট একটি ভবনে প্রবেশ করতেই আমাদের চোখে পড়ে- এখানকার বেশ কয়েকজন বাণিজ্যিক ভাড়াটিয়া ভবনটি ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিচ্ছেন।
ভাড়াটিয়ারা বলেন, ‘ভবনটিতে কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। যে ভবনে বিকল্প সিঁড়িসহ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আছে সেখানে আমরা চলে যাচ্ছি। এখানে আমরা নিরাপদ বোধ করছি না।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভবনটি আবাসিক-বাণিজ্যিকে মিশ্র। কিন্তু এখানে একটি মাত্র সিঁড়ি ছাড়া আর কোনো জরুরি বহির্গমনের ব্যবস্থা নেই। বাড়ির মালিক জানান, এভাবেই রাজউক থেকে প্ল্যান অনুমোদন পেয়েছেন।
এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, কততলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণে কী ধরনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখতে হবে?
ফায়ার সার্ভিসের অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩ অনুযায়ী, ৬ তলার উপরে যে কোনো ভবনকেই বহুতল ভবন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর এজন্য সব ক্যাটাগরিতেই নিতে হবে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা।
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের মুখপাত্র মো. শাহজাহান শিকদার বলেন, ‘আইনে ছয়তলার উপরের ভবনকে বহুতল ভবন বলা হয়েছে। আর এসব ভবনে অবশ্যই একটি জরুরি বহির্গমনের পথ রাখতে হবে।’
যদিও রাজউক বলছে, ১০ তলার নিচে কোনো ভবনকে বহুতল ভবন হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। ফলে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে আগুন নেভানোর জন্য যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়, তা দিয়ে নিচতলা থেকে সবোর্চ্চ ৬ তলা পর্যন্ত পানি ওঠানো যায় বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
নির্মাণাধীন বহুতল ভবন
রাজউকের প্রধান নগর স্থপতি মোস্তাক আহমেদ বলেন, ১০ তলা ভবনে আমরা একটি সিঁড়ি দিয়ে থাকি। আর ১০ তলার ওপরের ভবনে দুটি সিঁড়ি দেয়া থাকে। আর আইনে বহুতল ভবনের যে মতপার্থক্য আছে সেটি সংশোধন করা হবে।
নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবীব বলেন, যেসব ভবন ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র ছাড়াই নির্মিত হচ্ছে স্বাভাবিকভাবেই সেগুলোর অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। তাই দুটি সংস্থার আইনের এই সমন্বয়হীনতা দূর করতে না পারলে যথাযথভাবে নগরের অগ্নিপ্রতিরোধের পরিকল্পনা নেয়া যাবে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ফায়ার সার্ভিসের আইনটি ২০০৩ সালে প্রণয়ন করা হলেও তাদের কোনো মতামত ছাড়াই ২০২০ সালে রাজউকের বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড প্রণয়ন করা হয়। সেই আইনেই বহুতল ভবনের আলাদা ব্যাখ্যা দেয়া হয়। যদিও রাজউকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অচিরেই ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে আলোচনা করে আইন দুটিকে সমন্বয় করে বহুতল ভবনের একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা ঠিক করা হবে।