রাশিয়ায় উত্তর কোরিয়ার হাজারও সেনার প্রশিক্ষণ চলছে বলে মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য প্রকাশের পর উদ্বেগের ঝড় উঠেছে বিভিন্ন মহলে। পশ্চিমা দেশগুলোর শঙ্কা, ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ সেনাদের শক্তি বাড়াতে সহযোগিতা করবে উত্তর কোরিয়ার সেনারা।
রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার সেনাদের উপস্থিতিতে আরও একটি কারণে নড়েচড়ে বসেছে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্ররা। পশ্চিমাবিরোধী শক্তিরা এক হচ্ছে বলে বাজছে সতর্ক ঘণ্টা। বিশেষ করে পারস্পরিক সুবিধা দেয়া নেয়া পক্ষগুলোর মধ্যে দিন দিন সামরিক সম্পর্ক জোরালো হতে থাকাকে নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা জোট।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন বলেন, 'উত্তর কোরিয়ার সেনারা রাশিয়ায় গেছে বলে প্রমাণ হাতে এসেছে আমাদের। কী করছে তারা সেখানে? এখনও জানা বাকি। এমন এক বিষয় এটি, যা নিয়ে সকল প্রশ্নের উত্তর জানা প্রয়োজন।'
ইউক্রেনে আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে চলমান রুশ আগ্রাসনে এর আগে হাজারে হাজারে ইরানি ড্রোন ব্যবহার করেছে মস্কো। যুদ্ধরত দেশটিকে তেহরান স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইলও পাঠাচ্ছে বলে গেলো মাসে দাবি করে মার্কিন প্রশাসন। অন্যদিকে বেসামরিক নকশায় তৈরি হলেও প্রয়োজনে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারযোগ্য মাইক্রোইলেকট্রনিক্স ও যন্ত্রপাতি রাশিয়াকে দিচ্ছে চীন, এমন অভিযোগও রয়েছে।'
তবে এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া ও ইরান। কিন্তু পশ্চিমাদের চিরশত্রু এসব দেশের মধ্যে একতা ও সমন্বয় ক্রমশ বাড়ছে বলে সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কৌশল মূল্যায়ন করে- মার্কিন কংগ্রেস সমর্থিত এমন একটি গোষ্ঠী। বলছে, শক্তির নতুন বলয় তৈরি হচ্ছে এশিয়ার এই চার দেশকে ঘিরে, যাদের প্রত্যেকেরই অভিন্ন শত্রু শীর্ষ পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব।
হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা মুখপাত্র জন কিরবি বলেন, 'রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে নজিরবিহীন মাত্রায় সরাসরি সামরিক সহযোগিতা দেখছি আমরা। এতে ইউরোপ ও ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে।'
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধিতাই ঐক্যবদ্ধ করছে রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া ও ইরানকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টিকে ঝুঁকি হিসেবে দেখছে ওয়াশিংটন ও মিত্ররা। তাও শুধু একই অঞ্চলের জন্য নয়, বরং একই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য বহুমুখী ঝুঁকি।
কয়েক দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী শক্তির এমনই বলয় ছিল নাৎসি জার্মানি, ফ্যাসিবাদী ইতালি আর সাম্রাজ্যবাদী জাপানের। এরপর আসে পশ্চিমাবিরোধী শীতল যুদ্ধের যুগ। দশক পেরিয়ে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইরান, ইরাক আর উত্তর কোরিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু ও 'শয়তানের চক্র' আখ্যা দেয়ার পর রাশিয়ার নেতৃত্বে অলিখিত নতুন জোট হয়ে উঠতে শুরু করে দেশগুলো। যে শক্তি দৃশ্যমান হচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধে। ইউক্রেন যুদ্ধে নিরপেক্ষ বলে দাবি করলেও সামরিক মহড়া আর কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কে রাশিয়ার পাশে রয়েছে আরেক পরাশক্তি, যুক্তরাষ্ট্রের পর বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ অর্থনীতি এবং মার্কিন আধিপত্য বিরোধী চীনও।
বিশ্ব অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গবেষক ফেদর ভোয়তোলোভস্কি বলেন, 'আমার মনে হয় যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে চীন ও রাশিয়া ঐক্যবদ্ধ হলে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ইস্যুতে অনেক বড় পরিবর্তন আনতে সক্ষম।'
যুক্তরাষ্ট্রের দুশ্চিন্তার আরও বাড়ছে উত্তর কোরিয়া আর ইরানের মতো পারমাণবিক শক্তিধর দেশ রাশিয়ার ছায়ায় আসছে বলে। উত্তর কোরিয়া আর ইরান- যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় কোণঠাসা আর আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে দেশ দু'টিকে নগদ অর্থ, খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে আসছে অন্যতম শীর্ষ পরাশক্তি রাশিয়া। রাশিয়ার অস্ত্রভিত্তিক কূটনীতির ফলে ভবিষ্যতে মস্কোর গোপন ও শক্তিশালী সামরিক প্রযুক্তির নাগাল পেতে পারে ইরান আর উত্তর কোরিয়াও, বাড়ছে এমন শঙ্কা।
দক্ষিণ কোরিয়ার দংগুক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক কিম ইয়ং-হিউন বলেন, 'রাশিয়ায় মোতায়েন উত্তর কোরীয় সেনাদের হাতে যেসব রুশ অত্যাধুনিক অস্ত্র বা সামরিক সরঞ্জাম পৌঁছাবে, সেগুলো শুধু সেখানেই সীমিত থাকবে না। নিজেদের সামরিক সরঞ্জাম আধুনিকায়নে উত্তর কোরিয়ার জন্য এটি লোভনীয় সুযোগ আর তা লুফেও নেবে দেশটি।'
বর্তমান ধারা বজায় থাকলে ভবিষ্যৎ সংঘাতের কেন্দ্রে রাশিয়ার বদলে চীনকেও দেখা যেতে পারে, বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগর ও তাইওয়ান ইস্যুতে বলে মত দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা। এক্ষেত্রেও চার দেশের ঐক্যে বিপদ বাড়বে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বলয়ের। তবে আস্থা বা মতাদর্শের পরিবর্তে সুবিধা দেয়া-নেয়ার জোট বলে এশিয় শক্তির বলয়ের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বলেও মত অনেকের।