বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) রাফায় কোন গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা নিয়ে যায়নি ইসরাইলের সামরিক বাহিনী। এমনকি জানা ছিল না হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারের অবস্থান, যাকে হত্যার জন্য একবছর ধরে অপেক্ষা করছিলো ইসরাইল। চেহারা দেখে আর তথ্য-পরিচয় বিশ্লেষণ করে ইসরাইলি সেনারা নিশ্চিত হয়েছেন, তারা সিনওয়ারকে হত্যা করেছেন।
৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামলা চালানোর মূল পরিকল্পনাকারী এই সিনওয়ার হত্যার পর গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে বিশ্বের গণমাধ্যমগুলোতে নানা মতামত দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, এখন যদি ইসরাইল আর মিত্র দেশগুলো সমঝোতায় আসে, তাহলেই গাজায় যুদ্ধবিরতি সম্ভব। কারণ সিনওয়ারের মৃত্যুতে হামাসের নেতৃত্ব শূন্যতা তৈরি হয়েছে। হামাসের পরবর্তী নেতা কে হবেন, তা নিয়েও নেই স্পষ্ট নির্দেশনা। যে সুযোগ ইসরাইল কাজে লাগাতে পারে বলে মত বিশ্লেষকদের।
অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল সাবেক সিআইএ'র পরিচালক ডেভিড পেট্রাউস বলেন, 'ইসমাইল হানিয়ার পর হামাসের শক্তিশালী নেতা ছিলেন সিনওয়ার। হামাসের জন্য বড় আঘাত। হামাস এখন নেতৃত্বশূন্য। এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে নেতানিয়াহু। গাজায় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করে ইসরাইল যদি এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে যে, হামাসকে তারা এই উপত্যকায় চায় না, তাহলে আরব সম্প্রদায় সহযোগিতা করতে পারে। হামাস এখনও শেষ হয়নি। তারা ঘুরে দাঁড়াবে।'
অনেক বিশ্লেষক আবার বলছেন, সিনওয়ারকে লক্ষ্য করে হামলা হয়নি, সাধারণ সেনা অভিযানে তার মৃত্যু হয়েছে। গাজায় এখনও সক্রিয় হামাস। যে কারণে এতো জলদি এই উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করবে না ইসরাইল। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু এই অঙ্গীকার বারবার করেই যাচ্ছেন, হামাস নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত গাজায় সেনা অভিযান শেষ হবে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, হামাস দুর্বল হলেও ইসরাইলে অভিযান আর রকেট ছোড়ার সক্ষমতা এখনও আছে।
অন্যদিকে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে আরও ঘণিভূত হতে পারে সংকট। ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যুর পর এখন পর্যন্ত হামাসের প্রভাবশালী নেতাদের একজন ইয়াহিয়া সিনওয়ার। গাজার কাছে ইয়াহিয়া সিনওয়ারের অবস্থানও বেশ শক্তিশালী। যে কারণে শুধু গাজা কিংবা ইসরাইল নয়, এই হত্যাকাণ্ড ইস্যুতে সংঘাত নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে বলেও আশঙ্কা তাদের।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক নিরাপত্তা বিশ্লেষক জনাথন লর্ড বলেন, 'সিনওয়ার যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিরোধী ছিলেন। কারণ বন্দিদের মুক্ত করার বিপক্ষে ছিলেন তিনি । তিনি বিশ্বাস করতেন হামাস এই যুদ্ধ জিতবে। আর ফিলিস্তিনিরাও ত্যাগ স্বীকার করতে জানে। যে কারণে যুদ্ধ গাজাকে শেষ করে দিলেও সাধারণ মানুষের আক্রোশ ইসরাইলের প্রতি বাড়তেই থাকবে। পুরো মধ্যপ্রাচ্যে আরও বেড়ে যেতে পারে সংঘাত।'
বিশ্লেষকদের মতে, ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মৃত্যুর পরও হামাস-নেতা, ইয়াহিয়া-সিনওয়ার, হত্যাকাণ্ড, গাজা, যুদ্ধবিরতি, বিশ্ব-সম্প্রদায়, হামাস-ইসরাইল, মধ্যপ্রাচ্যে, সংঘাত, গুপ্তহত্যা, ইসরাইলি-সেনা, আরব-সম্প্রদায়র স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস, ইসরাইলের বিরুদ্ধে অবস্থান থেকে সরবে না। নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে ইসরাইল বিরোধিতা রয়েছে উপত্যকাটির মানুষের মধ্যেও। এক্ষেত্রে কোন সন্ত্রাসীকে মেরে ফেললে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে, গাজার সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এমনটি প্রযোজ্য নয়।
সিনওয়ারকে ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামলার পর থেকে হন্যে হয়ে খুঁজছিলো দেশটির সামরিক বাহিনী। বেশিরভাগ সময় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্তে অংশ নিতেন তিনি। সামরিক কার্যক্রমে খুব একটা দেখা যেতো না তাকে। বেশ কিছুদিন ধরেই গাজা উপত্যকার বিস্তৃত টানেলে লুকিয়ে ছিলেন তিনি।
বিভিন্ন সূত্র বলছে, তিনি ইসরাইল, ইরান আর হিজবুল্লাহ'র ত্রিমুখী সংঘাত চাচ্ছিলেন, যেন গাজায় আগ্রাসন কিছুটা কমলে বাঁচতে পারেন তিনি। একের পর এক হামাস নেতাকে হত্যার পর সামরিক কার্যক্রম নিয়ে সরাসরি কোন নির্দেশনা দিতেন না সিনওয়ার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজা আর ইসরাইলের মধ্যে চলা বহু বছরের সংঘাত এই এক নেতার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হবে, সেই সম্ভাবনা নেই। এই অঞ্চলের প্রতিটা যুদ্ধ পরবর্তী যুদ্ধের বিষাক্ত বীজ বুনেই শেষ হয়। সিনওয়ারের হত্যাকাণ্ড হামাসকে সাময়িকভাবে দুর্বল করলেও দীর্ঘমেয়াদে হামাস ঘুরে দাঁড়াবে বলেই মত তাদের।