স্ত্রী-সন্তান টানা তিনদিন না খেয়ে থাকায় মিয়ানমারের ম্যান্দালে শহরের একটি ইন্টারনেট ক্যাফেতে ঢুকেছিলেন পেশায় পণ্য সরবরাহকারী গাড়িচালক, যার ছদ্মনাম মং মং। সেই সময়টি ছিল ২০২২ সালের শেষ দিকে।
এর কয়েক মাস পর, ২০২৩ সালের জুলাইয়ে নিজের কিডনি প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচারের জন্য ভারতে যান ওই ব্যক্তি। ধনাঢ্য এক চীনা-বার্মিজ ব্যবসায়ীর কাছে মংমং নিজের কিডনি বিক্রি করেন বার্মিজ মুদ্রায় এক কোটি কিয়াত বা তিন হাজার ডলারের বেশি মূল্যে।
২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, একটি কিডনি বিক্রির এ অর্থ মিয়ানমারের শহরাঞ্চলে গড় বার্ষিক আয়ের প্রায় দ্বিগুণ। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের বছরব্যাপী অনুসন্ধানের প্রেক্ষিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি মং মংয়ের ঘটনা দিয়ে শুরু হলেও এটি কেবল মং মংয়ের একার গল্প নয়।
সিএনএন বলছে, নিজেদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করার জন্য মরিয়া হয়ে আছে মিয়ানমারের অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠী। তাদের অনেকেই ধনীদের খোঁজে তন্ন তন্ন করে চষে বেড়াচ্ছেন ফেসবুক। দালালদের ধরে ভারতে গিয়ে অঙ্গ বিক্রি ও প্রতিস্থাপন করছেন, যা অবৈধ দুই দেশেই। অঙ্গ বিক্রেতা, ক্রেতা আর দালাল- এমন অন্তত ২৪ জন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে সিএনএন। খুঁজে বের করেছে বার্মিজ ভাষায় পরিচালিত ফেসবুকের অন্তত তিনটি গ্রুপ। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ফেসবুকের স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান মেটা একটি অনলাইন গ্রুপ মুছে ফেলার কথা জানালেও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি দেয়নি। মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেনাবেচার পোস্ট ফেসবুকের নীতি অনুযায়ী নিষিদ্ধ।
অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটিয়ে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের তিন বছর পেরিয়ে গেলেও, জাতিসংঘের তথ্যমতে, এসময়ে দেশটিতে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি, যা ২০১৭ সালের তুলনায় দ্বিগুণ। সামরিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সংঘবদ্ধ আক্রমণে সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে গোটা মিয়ানমারে। কমেছে বিদেশি বিনিয়োগ, আকাশ ছুঁয়েছে বেকারত্ব আর নিত্যপণ্যের দাম। এমন পরিস্থিতিতেই দু'বেলা দু'মুঠো খাবার জোগাড়ে তাৎক্ষণিক সমাধান হিসেবে কিডনি বিক্রির পথ বেছে নিয়েছে মিয়ানমারের হতদরিদ্ররা। তাদের তুলনায় আর্থিক সক্ষমতা বেশি হলেও ভালো নেই ক্রেতারাও।
সেনাশাসক মিন অং হ্লাইংয়ের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারে মাত্র ৩০৮টি সফল কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে। করোনা মহামারি আর সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে কেবল সামরিক হাসপাতালেই মিলছে অঙ্গ প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচারের অনুমতি। অভ্যুত্থান পরবর্তী রক্তক্ষয়ী গণআন্দোলনে যোগ দেয়ায় এবং সেনাবাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আহত গণতন্ত্রপন্থি বিক্ষোভকারীদের চিকিৎসা দেয়ায় চড়া মাশুল গুণতে হয়েছিল মিয়ানমারের চিকিৎসকদের। অনেকেই গ্রেপ্তার বা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় আগেই ভঙ্গুর স্বাস্থ্যখাত চলে যায় খাদের কিনারায়। তাই পয়সা থাকলেও ভালো চিকিৎসা পান না মিয়ানমারের ধনীরা।
এমন পরিস্থিতিতে প্রতিবেশি ভারতের দ্বারস্থ হন বিপুলসংখ্যক বার্মিজ নাগরিক। অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতা দু'পক্ষেরই সহায় দালালরা। ভারতে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেনাবেচা অবৈধ এবং কেবল আত্মীয়দের মধ্যে অঙ্গদান বৈধ বলে দেশটিতে প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচারের অনুমোদন পেতে আইনজীবী ও নোটারির মাধ্যমে জমা দিতে হয় বংশবৃত্তান্তসহ অসংখ্য নথিপত্র। নয়াদিল্লিতে মিয়ানমার দূতাবাস এসব কাগজ যাচাই করে দেয় চূড়ান্ত অনুমোদন। এই অনুমোদনের জন্য কাগজপত্র জাল করা থেকে শুরু করে এমনকি কিডনির ক্রেতা-বিক্রেতার বিয়ের ভুয়া প্রমাণপত্রও দাখিল করে দালালরা। সফল প্রতিস্থাপন হলেও পরে কিডনি দাতা ও গ্রহীতা- দু'জনেরই রয়ে যায় প্রাণঘাতী ইনফেকশন, বিশেষ করে দাতার দেহের বাকি একটি কিডনিও পড়ে নষ্টের ঝুঁকিতে।
ভারতের জাতীয় অর্গ্যান অ্যান্ড টিস্যু ট্রান্সপ্লান্ট অর্গানাইজেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে ২০২২ সালে প্রায় ১০ হাজার জীবিত দাতা কিডনি দান করেছেন। এদের মধ্যে মিয়ানমারের নাগরিকদের অস্ত্রোপচারের সংখ্যা কত, সে তথ্য অবশ্য পাওয়া যায়নি। নয়াদিল্লির মিয়ানমার দূতাবাস আর ভারতের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাছে এ বিষয়ে জানতে চেয়েও সাড়া পায়নি সিএনএন।