২ এপ্রিল ২০২৫। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মুক্তির ডাক দিয়ে এদিন বিশ্বব্যাপী আমদানি পণ্যে সম্পূরক শুল্কের বোঝা চাপিয়ে দেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যেখানে শুল্কের হার ছিল সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪৯ শতাংশ পর্যন্ত। আর চীনের ক্ষেত্রে তা কয়েক ধাপে বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় ১২৫ শতাংশ। লক্ষ্য ছিল, অন্যায্য বাণিজ্যের অনুশীলন বন্ধ করা। দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক অংশীজনদের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা।
ট্রাম্পের ওই ঘোষণার এক সপ্তাহ না যেতেই পুঁজিবাজার থেকে হারিয়েছে ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ। যা বৈশ্বিক জিডিপির ১০ শতাংশ বা ১৫০টি দেশের সম্মিলিত জিডিপির চেয়েও বেশি। এতে বাধ্য হয়েই সম্পূরক শুল্কারোপ আগামী ৩ মাসের জন্য পেছাতে বাধ্য হন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যদিও এখনো বলবত রয়েছে চীনা পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ১২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক। বিপরীতে মার্কিন পণ্যে ৮৪ শতাংশ পাল্টা শুল্ক বসিয়েছে চীন।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবি, ওয়াশিংটনের শুল্কারোপকে ভয় পায় না বেইজিং। মানা হবে না যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি ও ব্ল্যাকমেইল। এর শেষ দেখে নেয়ার জন্য প্রস্তুত শি জিনপিং সরকার। শুল্ক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র পরাজিত হবে বলেও মন্তব্য করা হয়।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের গুণ্ডামির তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। চীন কোনো প্রকার চাপ, হুমকি ও ব্ল্যাকমেইল মেনে নেবে না। যুক্তরাষ্ট্র সংলাপ চাইলে আমাদের সম্মান দেখাতে হবে। কিন্তু শুল্ক যুদ্ধ ও বাণিজ্য যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চাইলে আমরা এর শেষ দেখে নেয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছি।’
গেলো বছর দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল সাড়ে ৫৮ হাজার কোটি ডলার। যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি সাড়ে ২৯ হাজার কোটি ডলার। এই অর্থ দেশটির অর্থনীতির ১ শতাংশ। তাই পাল্টাপাল্টি শুল্ক কার্যকরের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগের মেয়াদেই যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক এড়ানোর রাস্তা খুঁজে বের করে চীন। এসময় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় কারখানা স্থাপন করে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে শুল্ক বাঁধা উপেক্ষা করে মার্কিন মুল্লুকে পৌঁছাচ্ছে চীনের ফিনিশড প্রোডাক্ট। এছাড়াও গেলো ৮ বছরে বাণিজ্য বিকেন্দ্রীকরণের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল নয় চীন। ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে বিকল্প বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে চীনের সঙ্গে সখ্যতা বাড়াচ্ছে ইইউ।
এলকানো রিয়াল ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক মারিও এস্তেবান বলেন, ‘চীন ও ইইউ, সবাই নতুন অংশীদার খুঁজছে। যুক্তরাষ্ট্রের বলয় থেকে বের হতে চাইছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এখন সবচেয়ে শত্রুভাবাপন্ন অংশীদারে পরিণত হয়েছে। যেহেতু চীন ও ইইউ বিশ্বের দুটি বড় অর্থনীতি, তাই তারা নিজেদের মধ্যে অর্থনীতি বাড়ানোর পথ খুঁজছে।’
চীনে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ রপ্তানি পণ্যের তালিকায় রয়েছে সয়াবিন, এয়ারক্রাফট এন্ড ইঞ্জিন, আইসি, ফার্মাসিউটিক্যালস ও পেট্রোলিয়াম। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র আমদানি করে চীনের ইলেকট্রিক পণ্য, ব্যাটারি, খেলনা ও টেলিকম যন্ত্রাংশ। পাল্টাপাল্টি শুল্কারোপের কারণে পণ্যগুলোর মূল্য ৫ থেকে ৬ গুণ বৃদ্ধির শঙ্কা রয়েছে।
তবে ঘুড়ির নাটাই এখনো চীনের হাতে। কারণ দেশটি কপার ও লিথিয়ামের মতো দুর্লভ খনিজের প্রাচুর্যে ভরপুর। ইতোমধ্যে সামরিক বাহিনীর থার্মাল ইমেজিং ও রাডার তৈরিতে অন্যতম প্রয়োজনীয় খনিজ জার্মেনিয়াম ও গ্যালিয়াম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে শি জিনপিং সরকার। তবে পাল্টা চাপ প্রয়োগের জন্য চীনে অত্যাধুনিক মাইক্রোচিপ রপ্তানি বন্ধ রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় চ্যাটজিপিটি কিংবা জেমিনিকে টেক্কা দিতে বেগ পেতে হচ্ছে বেইজিংয়ের প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
এবার আসা যাক দুই সুপার পাওয়ারের শুল্ক যুদ্ধে বিশ্ব বাণিজ্যে প্রভাবের বিষয়ে। বৈশ্বিক অর্থনীতির ৪৩ শতাংশ এই দুই দেশের ওপর নির্ভরশীল। তাই পুরোদমে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হলে কমবে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি, এমনকি কয়েক দশক পর ফিরতে পারে অর্থনৈতিক মন্দাও।