উচ্চশিক্ষা আর উন্নত কর্মক্ষেত্রের হাতছানিতে উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডায় প্রতি বছর পা রাখেন বহু বিদেশি শিক্ষার্থী ও পেশাজীবী, যাদের বড় একটি অংশ ভারতের নাগরিক। চলমান কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের জেরে এরই মধ্যে কানাডায় ভারতীয়দের ভিসা আবেদন ৭০-৮০ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৩০ শতাংশে।
ভারতের নয়া দিল্লি এডুকেশন কাউন্সিলর শশী পান্ডে বলেন, 'আগে দিনে যদি আমি ১শ'টা আবেদন পেতাম, এর ৭০ থেকে ৮০টাই থাকতো কানাডায় যাওয়ার জন্য। কিন্তু গত বছর জি-টোয়েন্টি সম্মেলনের পর ভারত-কানাডা সম্পর্কে তিক্ততা শুরুর সময় থেকেই আবেদন কমতে শুরু করেছে। এখন এ হার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে।'
গেলো বছর কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশে ভারতীয় বংশোদ্ভূত শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরকে হত্যার ঘটনায় ফাটল ধরে অটোয়া-নয়াদিল্লি সম্পর্কে। হত্যাকাণ্ডে ভারত সরকারের গোয়েন্দারা জড়িত বলে তখন থেকেই অভিযোগ কানাডা সরকারের। খালিস্তানপন্থী শিখ নেতাদের ভারতীয় অখণ্ডতার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখলেও নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে নয়া দিল্লি। বরং ভারতের বারংবার অনুরোধ আমলে না নিয়ে অপরাধীদের ফেরত না পাঠিয়ে এখন তাদের অপরাধের জন্য ভারত সরকারকেই কানাডা দায়ী করছে বলে বৃহস্পতিবার অভিযোগ করে নয়া দিল্লি।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রনধীর জয়সোয়াল বলেন, 'এটা খুব অদ্ভুত বিষয় যে যাদের ফেরত পাঠাতে বলা হয়েছিল, যাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিতে বলেছিলাম, এখন জানছি যে তারাই কানাডায় বিভিন্ন অপরাধ ঘটাচ্ছে এবং সেজন্য আমাদেরকেই, অর্থাৎ ভারতকে দোষারোপ করা হচ্ছে। পরস্পরবিরোধী এসব কথা ও কাজ আমরা বুঝি না।'
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, গত এক দশক বা আরও বেশি সময় ধরে ২৬ ভারতীয়কে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ কানাডায় আটকে আছে। এছাড়াও কিছু অপরাধীকে গ্রেপ্তারের অনুরোধও থমকে আছে কানাডায়। এদের মধ্যে কয়েকজনের সন্ত্রাসবাদসহ নানা অপরাধে অভিযুক্ত। সব জেনেও তাদের আশ্রয় দিয়েছে কানাডা সরকার।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, 'আমরা কানাডা সরকারকে লরেন্স বিষ্ণোইসহ বিভিন্ন অপরাধী চক্রের সদস্যদের তথ্যসহ সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা ইস্যুগুলো জানিয়েছি। তাদের গ্রেপ্তার কিংবা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার জন্যও অনুরোধ করেছি। এসব তথ্য জানানো সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত কানাডার দিক থেকে আমাদের অনুরোধ আমলে নেয়া বা কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এটা খুব গুরুতর একটি বিষয়।'
নিজ্জর হত্যায় ভারতীয় গুপ্তচরদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে বলে গেলো সপ্তাহে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর অভিযোগের প্রেক্ষিতে ফের উত্তাপ বাড়তে শুরু করে দু'দেশের মধ্যে। কোনো প্রমাণ ছাড়া কানাডার এসব অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি ভারতের।
এদিকে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় আর্থ-রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে দ্বন্দ্বে বরাবরের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের নীরবতায় চাপে কানাডা।
কানাডার জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জো অ্যাডাম জর্জ বলেন, 'বাইডেন প্রশাসন ভীষণ পেশাদারিত্বের সঙ্গে পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তারা জানে যে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারত কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। বিশেষ করে চীনকে মোকাবিলার প্রশ্নে। তাই তারা পরিস্থিতি সামলানোর বিষয়ে ভীষণ কৌশলী। ট্রুডো সরকার একেবারেই এ পথে হাঁটছে না।'
ভারতের পাঞ্জাবের পর বিশ্বে শিখ সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় বসতি কানাডায়। ভারত থেকে আলাদা হয়ে খালিস্তান নামে রাষ্ট্রের দাবি সেখানকার অনেক শিখ নেতার, যা ক্ষোভের কারণ ভারত সরকারের।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নয়া দিল্লিকে না খেপিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মতো কানাডও কূটনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতো।