চিকিৎসাবিজ্ঞানে মৃত্যু ও আইসিইউর ভূমিকা (Definition of Death and Role of ICU)
চিকিৎসাবিজ্ঞানে মৃত্যু (Clinical Death) বলতে হৃদস্পন্দন, শ্বাস-প্রশ্বাস এবং মস্তিষ্কের কার্যক্রম (Brain Activity) স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়াকে বোঝায়। আইসিইউর যন্ত্রগুলো মূলত জীবিত দেহের দুর্বল অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে সচল রাখতে সহায়তা করে। কিন্তু মৃত্যুর পর কোষীয় স্তরে শক্তি উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কোনো ওষুধ বা ভেন্টিলেটর (Ventilator) আর কাজ করে না।
প্রখ্যাত আইসিইউ বিশেষজ্ঞ ডা. আশরাফ জুয়েল বলেন, “চিকিৎসা একটি প্রমাণভিত্তিক বিজ্ঞান (Evidence-based Science)। আইসিইউতে প্রতিটি জীবনচিহ্ন বা ভাইটাল সাইন (Vital Signs) মনিটরে রেকর্ড হয়, তাই এখানে মৃত্যু গোপন করার কোনো সুযোগ নেই।”
আরও পড়ুন:
ভেন্টিলেশনে কতদিন রাখা যায়? (Duration of Mechanical Ventilation)
আইসিইউতে একজন রোগীকে ভেন্টিলেশনে রাখার সময়কাল নির্ভর করে তার ফুসফুসের কার্যকারিতার ওপর। সাধারণত ১ থেকে ২ সপ্তাহ ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। তবে রোগী নিজে শ্বাস নিতে অক্ষম হলে এটি কয়েক মাস পর্যন্ত চলতে পারে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী ভেন্টিলেশনে নিউমোনিয়া (Ventilator-associated Pneumonia) বা পেশি দুর্বলতার মতো ঝুঁকি বাড়ে। মৃত্যুর পর এই ভেন্টিলেশন চালিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ অর্থহীন, কারণ ফুসফুস তখন আর অক্সিজেন গ্রহণ করে না।
মৃত্যুর পর শরীরের পরিবর্তন (Post-mortem Changes in Body)
মৃত্যুর পর শরীর তার নিজস্ব নিয়মে পরিবর্তিত হতে থাকে। দেহের তাপমাত্রা কমতে থাকে (Algor Mortis), পেশি শক্ত হয়ে যায় (Rigor Mortis) এবং রক্ত এক জায়গায় জমাট বাঁধতে শুরু করে। এই জৈবিক প্রক্রিয়াগুলোকে কোনো আধুনিক লাইফ সাপোর্ট (Life Support System) দিয়েই থামিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
নৈতিকতা ও মানবিক দৃষ্টিকোণ (Medical Ethics and Humanity)
চিকিৎসা নৈতিকতা (Medical Ethics) অনুযায়ী, আইসিইউ একটি সীমিত সম্পদ। একটি শয্যা বা একটি ভেন্টিলেটর একজন জীবিত ও সংকটাপন্ন রোগীর জন্য অমূল্য। কোনো মৃত ব্যক্তিকে আইসিইউতে রাখা মানে হলো অন্য একজন জীবিত মানুষের প্রাণ রক্ষার সুযোগ কেড়ে নেওয়া। এছাড়া মানবিক দিক থেকেও মৃত ব্যক্তির মর্যাদা রক্ষা (Dignity of the Deceased) এবং পরিবারকে সত্য মেনে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা (BBC Bangla), আমেরিকান লাইব্রেরি অব মেডিসিন (American Library of Medicine), এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)।
আরও পড়ুন:
চিকিৎসাবিজ্ঞানে 'ব্রেইন ডেথ' (Brain Death) বা মস্তিষ্কের মৃত্যু একটি অত্যন্ত জটিল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাধারণত হার্ট অ্যাটাক বা শ্বাসকষ্টে মৃত্যুর চেয়ে এটি আলাদা মনে হলেও, চিকিৎসাগতভাবে এটিই চূড়ান্ত মৃত্যু।
ব্রেইন ডেথ (Brain Death) কী এবং কেন একে চূড়ান্ত মৃত্যু বলা হয়?
ব্রেইন ডেথ হলে কেন রোগীকে মৃত ঘোষণা করা হয়, সেটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিচে দেওয়া হলো:
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, ব্রেইন ডেথ হলো মস্তিষ্কের কার্যক্রম স্থায়ী এবং অপরিবর্তনীয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া। যখন একজন মানুষের মস্তিষ্কের স্টেম (Brainstem) কাজ করা বন্ধ করে দেয়, তখন শরীর নিজে থেকে শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা হারায় এবং জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় কোনো সংকেত আর পাঠাতে পারে না।
ব্রেইন ডেথ হলে কেন রোগীকে মৃত ঘোষণা করা হয়?
১. মস্তিষ্কের কার্যক্রম স্থায়ীভাবে বন্ধ (Irreversible Loss of Brain Function): মস্তিষ্ক হলো শরীরের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকারী অঙ্গ। ব্রেইন ডেথ হলে মস্তিষ্কের কোষগুলো মরে যায় এবং এগুলো আর কখনো পুনরুজ্জীবিত হয় না। আধুনিক চিকিৎসায় অন্য অঙ্গ কৃত্রিমভাবে সচল রাখা গেলেও মস্তিষ্ক সচল করার কোনো উপায় নেই।
২. শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা হারানো: মস্তিষ্কের স্টেম শরীরের স্বয়ংক্রিয় শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে। ব্রেইন ডেথ রোগীদের ভেন্টিলেটর (Ventilator) থেকে সরিয়ে নিলে তারা এক মুহূর্তও নিজে থেকে শ্বাস নিতে পারে না। যন্ত্রের মাধ্যমে অক্সিজেন দেওয়া হলেও মস্তিষ্ক ছাড়া শরীর তা দীর্ঘক্ষণ গ্রহণ করতে পারে না।
৩. অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অকার্যকারিতা: মস্তিষ্ক মৃত হওয়ার কিছুক্ষণ পর শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন কিডনি, লিভার এবং পরিপাকতন্ত্র ধীরে ধীরে অকেজো হতে শুরু করে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং হরমোন নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শরীর দ্রুত পচে যেতে শুরু করে।
৪. লাইফ সাপোর্ট কেবল একটি ভ্রান্তি (Illusion of Life): ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে রোগীর বুক ওঠা-নামা করে এবং হার্ট বিট বা হৃদস্পন্দন দেখা যায়। এটি দেখে মনে হতে পারে রোগী বেঁচে আছেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি কেবল যন্ত্রের মাধ্যমে শরীরে অক্সিজেন প্রবেশের ফল। মস্তিষ্ক ছাড়া এই হৃদস্পন্দনের কোনো মানে নেই।
আরও পড়ুন:
ব্রেইন ডেথ ও ক্লিনিক্যাল ডেথ-এর মধ্যে পার্থক্য (Brain Death vs. Clinical Death)
ক্লিনিক্যাল ডেথ: যখন হার্ট এবং শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়, তবে অনেক সময় দ্রুত চিকিৎসার মাধ্যমে এটি পুনরায় চালু করা সম্ভব হতে পারে।
ব্রেইন ডেথ: এটি এমন এক অবস্থা যেখান থেকে ফিরে আসার কোনো রেকর্ড নেই। এটিই চূড়ান্ত এবং আইনগত মৃত্যু।
অঙ্গদান এবং ব্রেইন ডেথ (Organ Donation):
ব্রেইন ডেথ ঘোষিত রোগীদের অঙ্গসমূহ (যেমন: হৃদপিণ্ড, কিডনি, কর্নিয়া) অন্য মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়। কারণ হার্ট বিট কৃত্রিমভাবে সচল রাখায় অঙ্গগুলো কিছুক্ষণ সতেজ থাকে। এই কারণেই ব্রেইন ডেথ ঘোষণা করা হলে চিকিৎসকরা দ্রুত পরিবারকে অঙ্গদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বলেন।
আরও পড়ুন:
কোমা বনাম ব্রেইন ডেথ: মূল পার্থক্য (Coma vs. Brain Death)
বৈশিষ্ট্য কোমা (Coma) ব্রেইন ডেথ (Brain Death) অবস্থা "রোগী গভীর অচেতন, কিন্তু বেঁচে আছেন।" এটি চিকিৎসাগত এবং আইনগতভাবে মৃত্যু। মস্তিষ্কের কাজ "মস্তিষ্ক ও ব্রেইন স্টেম সচল থাকে, কাজ কিছুটা ধীর হয়।" মস্তিষ্ক ও ব্রেইন স্টেম স্থায়ীভাবে অকেজো হয়ে যায়। ফিরে আসার সম্ভাবনা সঠিক চিকিৎসায় রোগী সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে পারেন। এখান থেকে ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। শ্বাস-প্রশ্বাস "রোগী অনেক সময় নিজে নিজেই শ্বাস নিতে পারেন।" "নিজে থেকে শ্বাস নেওয়া অসম্ভব, কেবল ভেন্টিলেটরে কৃত্রিম শ্বাস চলে।" শারীরিক প্রতিক্রিয়া ব্যথায় বা ডাকে রোগী সাড়া দিতে পারেন (যেমন- চোখ নড়ানো)। কোনো ধরণের উদ্দীপনা বা ব্যথায় শরীর সাড়া দেয় না। লাইফ সাপোর্ট লাইফ সাপোর্ট রোগীকে সুস্থ করতে সাহায্য করে। লাইফ সাপোর্ট কেবল অঙ্গগুলোকে কৃত্রিমভাবে সচল রাখে।
আরও পড়ুন:
আইসিইউ ও মৃত্যু সংক্রান্ত সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
প্রশ্ন: ব্রেইন ডেথ (Brain Death) হলে কি রোগী বেঁচে ফিরতে পারে?
উত্তর: না। চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্রেইন ডেথ মানে হলো মস্তিষ্কের স্থায়ী মৃত্যু। এখান থেকে কোনো রোগীর বেঁচে ফেরার কোনো রেকর্ড বা সম্ভাবনা নেই।
প্রশ্ন: হার্ট বিট চললে কেন রোগীকে মৃত বলা হয়?
উত্তর: অনেক সময় লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় কৃত্রিমভাবে হৃদস্পন্দন সচল রাখা হয়। কিন্তু যদি মস্তিষ্ক মৃত (Brain Dead) হয়ে যায়, তবে হৃদপিণ্ড সচল থাকলেও ব্যক্তিটিকে চিকিৎসাগতভাবে মৃত ঘোষণা করা হয়।
প্রশ্ন:মৃত ব্যক্তিকে আইসিইউতে রাখা কি অনৈতিক?
উত্তর: হ্যাঁ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের নীতি অনুযায়ী, যেখানে চিকিৎসার আর কোনো সম্ভাবনা নেই, সেখানে মৃত ব্যক্তিকে শয্যা দখল করে রাখা অনৈতিক। এতে অন্য একজন জীবিত সংকটাপন্ন রোগী চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।
প্রশ্ন: কোমা (Coma) এবং ব্রেইন ডেথ কি একই?
উত্তর: না। কোমার রোগী অচেতন থাকলেও তার মস্তিষ্ক সচল থাকে এবং সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু ব্রেইন ডেথ রোগীর মস্তিষ্ক স্থায়ীভাবে অকেজো হয়ে যায়।
প্রশ্ন: আইসিইউতে মৃত্যু কি গোপন করা সম্ভব?
উত্তর: না। আধুনিক আইসিইউ-এর মনিটরগুলোতে রোগীর প্রতিটি মুহূর্তের তথ্য সংরক্ষিত থাকে। হৃদস্পন্দন বা মস্তিষ্কের কাজ বন্ধ হওয়া মাত্রই যন্ত্রে তার প্রমাণ ধরা পড়ে, তাই মৃত্যু গোপনের সুযোগ নেই।
প্রশ্ন: লাইফ সাপোর্ট খোলার সিদ্ধান্ত কারা নেয়?
উত্তর: সাধারণত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটি বোর্ড রোগীর অবস্থা যাচাই করে ব্রেইন ডেথ নিশ্চিত করেন এবং এরপর পরিবারের সদস্যদের সাথে আলোচনা করে লাইফ সাপোর্ট খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।





