আসল ইলিশ মাছ চেনার জন্য মাছের শারীরিক গঠন, রং, চোখ, কানকো, এবং গন্ধ পরীক্ষা করা জরুরি। একটি ভালো ইলিশের পেট চওড়া ও উভয় প্রান্তে সরু হবে, পৃষ্ঠদেশ মোটা হবে এবং রং উজ্জ্বল হবে। এছাড়াও মাছের দুই চোখ স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল হবে এবং কানকো লালচে রঙের হবে। মাছের শরীর টাটকা থাকলে চাপ দিলে স্বাভাবিক হবে এবং একটি বিশেষ সুবাস থাকবে।
আসল ইলিশ চেনার কিছু উপায়
শারীরিক গঠন: ভালো ইলিশের শরীর চওড়া পেট ও সরু প্রান্তের হয়। পিঠ মোটা এবং শরীর গোল হবে, লম্বাটে নয়। সেই সঙ্গে মাছটির শরীর শক্ত এবং টানটান থাকবে, নরম বা ঢিলেঢালা হবে না।
রং ও উজ্জ্বলতা: আসল ইলিশ মাছের শরীর উজ্জ্বল প্রকৃতির হয়। রঙ হবে রূপালী এবং চকচকে, ফ্যাকাসে বা কালচে হবে না।
চোখ ও কানকো: মাছের চোখ হবে স্বচ্ছ, উজ্জ্বল এবং স্পষ্ট, ঘোলাটে নয়। কানকো টানলে যদি তা লালচে বা গোলাপি রঙের হয়, তাহলে মাছটি টাটকা।
গন্ধ: টাটকা ইলিশ মাছের একটি বিশেষ ও পরিচিত সুবাস থাকে। যদি মাছ থেকে কোনো দুর্গন্ধ আসে বা গন্ধ না থাকে, তাহলে তা টাটকা নয়।
পেট ও আঁশ: আসল ইলিশের পেট একটু চওড়া হবে এবং টানটান থাকবে। পেটে চাপ দিলে যদি তা নরম হয় তবে তা ভালো মানের ইলিশ নয়।
আকার: মাছের মুখ যতটা সরু হবে, মাছটি তত বেশি সুস্বাদু হবে।
নকল ইলিশ কেনা থেকে সাবধান: বাজারে অনেক সময় সার্ডিন বা কোকিলা মাছকে আসল ইলিশ বলে বিক্রি করা হয়। ইলিশের মতোই দেখতে হলেও এই মাছগুলোর স্বাদ ইলিশের মতো হয় না। তাই এগুলোর বৈশিষ্ট্যগুলো ভালো করে চিনে রাখতে হবে। চন্দনা ইলিশও দেখতে আসল ইলিশের মতো হয়, কিন্তু স্বাদ ও চর্বির পরিমাণে ভিন্নতা থাকে।
ইলিশ মাছের উপকারিতা
ইলিশ মাছ হার্ট ভালো রাখে, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে, দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে, হাড় ও দাঁত মজবুত করে এবং রক্তস্বল্পতা দূর করতে সাহায্য করে। এতে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড (ইপিএ ও ডিএইচএ) রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড কমায়, ভালো কোলেস্টেরল বাড়ায় এবং রক্তসঞ্চালন স্বাভাবিক রাখে, যা হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। এছাড়া এতে থাকা আয়রন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন এ, ডি, সি ও বি ১২ ইত্যাদি পুষ্টি উপাদান শরীরকে সুস্থ রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্য ভালো রাখে: ইলিশ মাছে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদপিণ্ডকে সুস্থ রাখে, রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড কমায় এবং ভালো চর্বি বাড়াতে সাহায্য করে, যা হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।
মস্তিষ্কের বিকাশ ও কার্যকারিতা: ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, বিশেষ করে ডিএইচএ, মস্তিষ্কের সঠিক বিকাশ এবং কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য, যা স্মৃতিশক্তি বাড়াতেও সাহায্য করে।
দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে: ইলিশ মাছে থাকা ভিটামিন এ দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে এবং চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
হাড় ও দাঁত মজবুত করে: এতে থাকা ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস হাড় এবং দাঁতকে মজবুত করে।
রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধ করে: ইলিশ মাছে থাকা আয়রন রক্তস্বল্পতা রোধ করতে সাহায্য করে।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: নিয়মিত ইলিশ খেলে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে, যা এই মাছের ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের কারণে ঘটে।
প্রোটিনের ভালো উৎস: ইলিশ মাছ প্রোটিনের একটি চমৎকার উৎস, যা শরীরের বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ইলিশের বৈশিষ্ট্য: ইলিশ মাছের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড-এ ভরপুর, যা হৃদপিণ্ড ও রক্ত সঞ্চালনের জন্য উপকারী। এটি একটি সামুদ্রিক মাছ হলেও প্রজননের জন্য বড় নদীতে আসে এবং ডিম পেড়ে বাচ্চা ফোটার পর আবার সাগরে ফিরে যায়। এর নরম, তৈলাক্ত মাংস এবং মিষ্টি স্বাদ এটিকে বাংলাদেশে জাতীয় মাছ হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে।
শারীরিক ও পুষ্টিগত বৈশিষ্ট্য
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড: ইলিশ মাছে উচ্চমাত্রায় ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড (ইপিএ ও ডিএইচএ) থাকে, যা রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড কমিয়ে ভালো চর্বি বাড়াতে সাহায্য করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
নরম ও তৈলাক্ত মাংস: ইলিশের মাংস নরম ও তৈলাক্ত হয়, যা এর বিশেষ স্বাদের জন্য পরিচিত।
ভিটামিন ও খনিজ উপাদান: এতে ভিটামিন এ, ডি, সি, এবং আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাসসহ বিভিন্ন খনিজ উপাদান থাকে, যা দৃষ্টিশক্তি, হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্য এবং রক্তস্বল্পতা রোধে সাহায্য করে।
প্রজনন ও আচরণগত বৈশিষ্ট্য
অ্যাড্রোমাস প্রজাতি: ইলিশ হলো একটি অ্যাড্রোমাস মাছ, যার অর্থ হলো এরা ডিম পাড়ার জন্য সমুদ্র থেকে বড় নদীতে আসে।
জীবনচক্র: নদী ও সাগরের মোহনায় ডিম পাড়ার পর বাচ্চা ইলিশ (জাটকা) নদীতে বড় হয় এবং খাদ্য-সমৃদ্ধ পরিবেশে বড় হওয়ার পর সাগরে ফিরে যায়।
পদ্মা-মেঘনা-যমুনা অববাহিকার গুরুত্ব: বঙ্গোপসাগরের ব-দ্বীপাঞ্চল এবং পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদীর মোহনার হাওর অঞ্চলে প্রচুর ইলিশ মাছ পাওয়া যায়।
জাটকা ইলিশের আকার: জাটকা হলো ১০ ইঞ্চি বা ২৫ সেন্টিমিটারের ছোট আকারের ইলিশ মাছ। এই মাপের ছোট ইলিশকে পূর্ণ বয়স্ক ইলিশ হওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য সংরক্ষণ করা হয়।
সংজ্ঞা: জাটকা বলতে মূলত ছোট আকারের ইলিশকে বোঝানো হয়, যার দৈর্ঘ্য ১০ ইঞ্চি বা ২৫ সেন্টিমিটারের কম।
উদ্দেশ্য: এই মাছগুলো যাতে পূর্ণবয়স্ক ইলিশে পরিণত হতে পারে এবং প্রজনন করতে পারে, সেজন্য এদেরকে ধরা নিষিদ্ধ করা হয় এবং সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
পরিমাপ: ইলিশ মাছের মুখ থেকে লেজ পর্যন্ত দৈর্ঘ্য হিসেব করে এই মাপ নির্ধারণ করা হয়।
ইলিশ মাছ রান্নার পদ্ধতি
ইলিশ মাছ রান্নার বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে, তবে হাতে মাখা ইলিশ একটি সহজ ও জনপ্রিয় রেসিপি। এর জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ হলো ইলিশ মাছ, পেঁয়াজ কুচি, কাঁচা মরিচ, হলুদ ও মরিচ গুঁড়া, লবণ এবং তেল।
প্রথমে মাছগুলো কেটে ভালো করে ধুয়ে নিন। এরপর একটি পাত্রে মাছের সঙ্গে পেঁয়াজ কুচি, হলুদ গুঁড়া, মরিচ গুঁড়া, লবণ, কাঁচা মরিচ ও পরিমাণ মতো তেল মিশিয়ে নিন। সবকিছু একসাথে ভালো করে মেখে একটি পাত্রে ঢেকে দিন এবং হালকা আঁচে রান্না করুন যতক্ষণ না জল শুকিয়ে আসে এবং মাছ সিদ্ধ হয়ে যায়।
উপকরণ:
ইলিশ মাছ: ৪ টুকরা
পেঁয়াজ কুচি: ৩-৪টি
হলুদ গুঁড়া: ১/২ চা চামচ
মরিচ গুঁড়া: ২ চা চামচ
কাঁচা মরিচ: ৬টি
লবণ: স্বাদমতো
তেল: পরিমাণ মতো
প্রণালী:
- প্রথমে ইলিশ মাছগুলো ভালো করে কেটে, ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিন।
- একটি পাত্রে মাছের টুকরোগুলো নিন এবং এর মধ্যে পেঁয়াজ কুচি, হলুদ গুঁড়া, মরিচ গুঁড়া, লবণ এবং কাঁচা মরিচ যোগ করুন।
- এবার পরিমাণ মতো তেল দিয়ে সব উপকরণ একসাথে ভালোভাবে মেখে নিন।
- একটি প্যানে মিশ্রণটি ঢেলে দিন।
- হালকা আঁচে ঢাকনা দিয়ে রান্না করুন। মাঝে মাঝে হালকাভাবে নেড়ে দিন যাতে মাছ প্যানের তলায় লেগে না যায়।
- মাছ সিদ্ধ হয়ে জল শুকিয়ে আসা পর্যন্ত রান্না করুন।
- গরম ভাতের সাথে পরিবেশন করুন সুস্বাদু হাতে মাখা ইলিশ মাছ।
পদ্মার ইলিশ চেনার উপায়:
পদ্মা-মেঘনার ইলিশের কোনো পার্থক্য নেই। নদীর মিঠাপানি আর খাদ্যের কারণে স্বাদের পার্থক্যটা হয়। আসল স্বাদের পার্থক্যটি হয় পরিবেশ ও খাদ্যের কারণে।
মিঠাপানি অর্থাৎ পদ্মা ও মেঘনার পরিবেশ এবং খাদ্যের মান ভালো থাকায় এখানকার ইলিশ স্বাদে ভিন্ন। মূলত পদ্মা ও মেঘনার ইলিশের মধ্যেই স্বাদ থাকে। শুধু যে পদ্মার ইলিশ সেরা সেটি নয়, মেঘনার ইলিশও সুস্বাদু। প্রচলিত কারণে সবাই পদ্মার ইলিশ বলে। পদ্মা-মেঘনা দুই নদীর ইলিশেই স্বাদ রয়েছে।
চাঁদপুরের পদ্মার ইলিশ চিনার উপায় হচ্ছে চোখ থাকবে কালো, মাছটি চওড়া, মাথা গোলগাল ও ছোট হবে। শরীর চকচক করবে। আর সাগরের ইলিশের শরীরে লালচে লালচে দাগ থাকে ও লম্বা হয়। লেজের আকৃতিও ভিন্ন। লেজের পাশে পিচ্ছিল থাকবে। অনেকেই এই বিষয়গুলো না জানার কারণে সাগরের ইলিশ কিনে নিয়ে যায়।
ইলিশ মাছের জীবনচক্র
ইলিশ মাছের জীবনচক্র শুরু হয় সাগর থেকে। ডিম ছাড়ার জন্য এরা ১২০০-১৩০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নদীতে আসে, যেখানে ডিম ফুটে বাচ্চা তৈরি হয় এবং বড় হয়ে আবার সাগরে ফিরে যায়। এদের জীবনে লিঙ্গ পরিবর্তন ঘটে, অর্থাৎ জীবনের প্রথম বছর পুরুষ হিসেবে থাকে এবং পরে নারীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য নারী ইলিশে রূপান্তরিত হয়।
জীবনের পর্যায়সমূহ
ডিম পাড়া ও লার্ভা: ইলিশ মাছ ডিম ছাড়ার জন্য সাগর থেকে নদীতে আসে। ডিম ফুটে লার্ভা বের হয় এবং তারা নদীতেই বড় হতে থাকে।
জাটকা: নদীতে বড় হওয়া ছোট ইলিশগুলোই জাটকা নামে পরিচিত। এদের একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের নিচে ধরা নিষিদ্ধ, যেমন বাংলাদেশে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৩ সেমি'র কম দৈর্ঘ্যের জাটকা ধরা নিষেধ।
পূর্ণবয়স্ক ইলিশ: জাটকাগুলো বড় হয়ে পূর্ণাঙ্গ ইলিশে পরিণত হয়।
প্রজনন: প্রজননকাল এলেই ইলিশ মাছ সাগর থেকে নদীতে আসে।
বিশেষ বৈশিষ্ট্য
লিঙ্গ পরিবর্তন: ইলিশ মাছের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এদের লিঙ্গ পরিবর্তন হয়। জীবনের প্রথম বছর পুরুষ হিসেবে থাকে এবং পরবর্তীতে নারী ইলিশে রূপান্তরিত হয়।
অ্যাক্টিকিক জীবনচক্র: ইলিশ মাছ সাধারণত সমুদ্রের লবণাক্ত পানি থেকে নদীতে আসে এবং নদী থেকে সাগরে চলাচল করে।
ইলিশের খাদ্যাভ্যাস
ইলিশ মাছ মূলত প্ল্যাঙ্কটন ভোজী, অর্থাৎ উদ্ভিদকণা ও প্রাণিকণা খেয়ে বেঁচে থাকে। এরা নীল-সবুজ শৈবাল, ডায়াটম, ডেসমিড, কোপিপোড এবং রটিফারের মতো ক্ষুদ্র জীব খায়। ইলিশের খাদ্যাভ্যাস বয়স ও ঋতুর ওপর নির্ভরশীল, যেখানে অপ্রাপ্তবয়স্করা উদ্ভিদকণা এবং বয়স্করা প্রাণিকণা ও জৈব আবর্জনা খায়।
প্ল্যাঙ্কটন ভোজী: ইলিশ মাছ প্রধানত প্ল্যাঙ্কটন (উদ্ভিদ ও প্রাণী কণা) খেয়ে থাকে।
খাদ্যের প্রকারভেদ: এদের খাদ্য তালিকায় বিভিন্ন প্রকার শৈবাল, ডায়াটম, ডেসমিড, কোপিপোড এবং রটিফার অন্তর্ভুক্ত।
অপ্রাপ্তবয়স্ক ইলিশ: এরা প্রধানত উদ্ভিদকণা গ্রহণ করে।
প্রাপ্তবয়স্ক ইলিশ: এরা প্রাণিকণা খায় এবং এর পাশাপাশি কিছু জৈব আবর্জনাও গ্রহণ করে।
অভিপ্রয়ানের সময়: মাছ ডিম ছাড়ার পর প্রচুর পরিমাণে খাবার খায়।
খাদ্য গ্রহণ না করা: অভিপ্রয়ানের বা মাইগ্রেশনের সময় ইলিশ মাছ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে খাবার গ্রহণ করে না।
গিল র্যাকার: ইলিশ মাছের গিল র্যাকার চালুনির মতো হওয়ায় এদের খাদ্য নির্বাচনে তেমন কোনো বিশেষত্ব থাকে না।
পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাস: বর্তমানে নদীদূষণের কারণে ইলিশের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আসছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ইলিশের পেটে বালি ও ধ্বংসাবশেষের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা এদের খাদ্যের একটি বড় অংশ দখল করছে। এ পরিবর্তনের ফলে ইলিশের স্বাভাবিক স্বাদ ও গন্ধও আগের মতো থাকছে না বলে মনে করা হচ্ছে।





