নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার একটি পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানায় গাছের ছায়া আর সবুজে ঘেরা প্রাঙ্গণ কারখানার কর্মপরিবেশকে করেছে মনোরম।
ভিতরে পুকুর থেকে শুরু করে রয়েছে শ্রমিকদের জন্য বিশ্রাম নেয়ার জায়গা। এসবই শীতল আর ঠাণ্ডা করেছে কারখানাটির পরিবেশ।
লিড সনদপ্রাপ্ত তিনতলা বিশিষ্ট সবুজ এই কারখানার দ্বিতীয় তলায় চলে মূল কাজ। যেখানে শ্রমিক রয়েছে পাঁচ শতাধিক। তীব্র গরমের মধ্যেও যারা কাজ করছেন তারা যেন অসুস্থ হয়ে না পড়েন সেজন্য রয়েছে খোলামেলা পরিবেশ আর প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা।
একজন শ্রমিক বলেন, 'এখানে অনেক ফ্যান আছে, সাথে এয়ারকুলারের ব্যবস্থা আছে। এই জায়গায় কাজ করে আমাদের অনেক শান্তি লাগছে। বাইরে যে পরিমাণ গরম, এখানে সেই গরমটা নেই। সেদিক থেকে আমরা অনেক শান্তিতে কাজ করছি এখানে। আবার গরমের জন্য অফিস থেকেই স্যালাইন দেয়া হচ্ছে।'
ফতুল্লাহ অ্যাপারেলসের মতো দেশে এখন সবুজ কারখানার সংখ্যা ২১৫টি। এসব কারখানায় কর্মপরিবেশ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুয়ায়ী হওয়ায় এখানে আলো-বাতাস রয়েছে বেশ। ফলে কারখানার বাহিরের তাপমাত্রা যাই হোক সহনীয় ভেতরের পরিবেশ। তাই এখানে শ্রমিকরা কাজ করছেন স্বাচ্ছন্দ্যে। তবে প্রশ্ন থেকে যায় সবুজ কারখানা নয় এমন সাধারণ কারখানার পরিবেশ নিয়ে।
ছোটবড় মিলিয়ে দেশে পোশাক কারখানার সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি। যেখানে কাজ করছে ৩০ লাখের বেশি শ্রমিক। তাদের হাতের স্পর্শে দেশের শীর্ষ রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক। রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। কিন্তু শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ কি সকল কারখানায় নিশ্চিত হয়েছে?
রাজধানীর মিরপুরের কয়েকটি পোশাক কারখানার চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। পরিবেশ এমন যেন ফ্ল্যাট বাড়িতে হয়েছে কারখানার পুরো আয়োজন। ছোট জানালা আর আলো বাতাসের কম উপস্থিতি পরিবেশকে করেছে গুমোট, স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়েছে শ্রমিকদের।
একজন শ্রমিক বলেন, 'গরমে তো আমারেদ অনেক সমস্যা হয়ে থাকে। কাজ করতে অনেক কষ্ট হয়। ফ্যান চলে কিন্তু তারপরও কাজ হয় না। আমাদের মাথা ব্যাথা হয়।'
সম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, দেশে প্রতি বছর তীব্র গরমে ৩ হাজার ২০০ কোটি কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। উচ্চ তাপমাত্রায় শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়া শীর্ষ ৫ দেশের মধ্যে নাম রয়েছে বাংলাদেশের। এমন অবস্থায় ডাইংসহ বেশকিছু কারখানায় প্রায় ৪০ শতাংশ উৎপাদন কমেছে এবং শ্রমিক উপস্থিতি কমেছে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। আর সার্বিকভাবে শ্রমিকের কর্মদক্ষতা কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ।
ফতুল্লাহ অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে শামীম এহসান বলেন, 'আমাদের ফ্যাক্টরিটা অনেক বেশি গাছপালার মাঝে। সেজন্য ফতুল্লায় আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি। তবে আমারেদ ডাইং ইউনিটে প্রায় প্রতিদিনই ২০ থেকে ৩০ শতাংশ শ্রমিক অনুপস্থিত থাকতো। স্বভাবগত কারণেই ডাইংয়ের গরম একটু বেশি থাকে।'
শ্রমিকের কাজের স্থানে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ও স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে শ্রম আইনে কারখানার অবকাঠামো পরিবর্তনের নির্দেশনা দেয়া থাকলেও প্রায় ৯২ শতাংশ কারখানায় তা যথাযথভাবে মানা হয়নি। এক্ষেত্রে শ্রম পরিবেশের মানদণ্ড পুনর্বিবেচনার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। এছাড়া নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে নতুন করে বিনিয়োগের কথা বলছেন তারা।
অর্থনীতিবিদ ড. এম এ রাজ্জাক বলেন, 'আগে যেভাবে শ্রম পরিবেশের মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটা সামনের দিনগুলোতে যাচাই-বাছাই করে পুনর্বিবেচনা করার সময় আছে। আর আমরা যদি কোনোকিছু না করে ফেলে রাখি তাহলে ডায়াসে তারা নতুন নতুন নিয়ম আনতে পারে, যেটা আমাদের জন্য ভালো নাও হতে পারে।'
কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও বন্যার কারণে তৈরি পোশাক খাতে প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই কারখানায় শীতল পরিবেশ নিশ্চিতে স্থায়ী পদক্ষেপের পাশাপাশি টেকসই নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরির পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের।