চট্টগ্রাম বন্দরের রাজস্ব আয়ের প্রায় অর্ধেক যোগান দেয় নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল-এনসিটি। ২০০৭ সালে নির্মিত, আড়াই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের এই টার্মিনালে অপারেটর নিয়োগে নিয়ে শুরু থেকেই ছিল অনিয়মের অভিযোগ।
প্রথম কয়েক বছর উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে দেশিয় অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক এনসিটি চালালেও দীর্ঘ দিন ধরে বিনা টেন্ডারে, বারবার মেয়াদ বাড়িয়ে উন্মুক্ত ক্রয় পদ্ধতিতে কাজ করছে সাইফ পাওয়ারটেক। এই প্রক্রিয়া বহাল রেখেই ২০২৩ সালে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম টার্মিনাল অপারেটর, দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ডকে এনসিটি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিগত সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারও এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিলেও উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে অপারেটর নিয়োগ সময় সাপেক্ষ হওয়ায় জানুয়ারিতে আবার সাইফ পাওয়ারটেকের চুক্তির মেয়াদ ছয় মাস বাড়ানো হয়। যা শেষ হবে ৬ জুলাই।
যদিও বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে না দিয়ে এনসিটি বন্দরের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালনার দাবি জানিয়ে আন্দোলন করছে শ্রমিক কর্মচারীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এরআগে ২০০৯ সালে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দিতে দরপত্র আহ্বান করা হলেও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও এমপিদের হস্তক্ষেপে বাতিল হয়।
এবার সাইফের সাথে চুক্তির মেয়াদ আর না বাড়িয়ে গেল ১৮ জুন নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক সভায় ছয় মাসের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরকে এনসিটি চালানোর জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এরপরই নিজস্ব ব্যবস্থায় এনসিটি চালাতে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি পরিচালনা ও আইটি খাতে ৪২ কোটি টাকা ব্যয়ের অনুমোদন দিতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন বন্দর চেয়ারম্যান।
পণ্য খালাসে প্রয়োজনীয় শ্রমিক না দেয়া এবং অতিরিক্ত বিল করাসহ সাইফ পাওয়ারটেকের কাছে বন্দর ব্যবহারকারীরা জিম্মি ছিলেন দাবি করে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন সিএন্ডএফ এজেন্টরা। এদিকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় গেলেও সেবার গতি যাতে ব্যাহত না হয় তা সেদিকে লক্ষ্য রাখার তাগিদ বন্দর ব্যবহারকারীদের।
চট্টগ্রাম কাস্টম এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. শওকত আলী বলেন, ‘১৭ বছর ধরে আন্দোলন হয়েছিল, কেউ কিছু করতে পারেনি। একটা দুর্নীতি থেকে আমরা মুক্ত হেয়ছি। একচ্ছত্র আধিপত্য থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি। চট্টগ্রাম বন্দরের সমস্ত ইকুয়েপমেন্ট চট্টগ্রাম বন্দরের। চট্টগ্রাম বন্দর ছয় মাসের জন্য এই এনসিটি চালানো কোনা সমস্যা আছে বলে আমি মনে করি না।’
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সজুন বলেন, ‘আমাদের যে জাহাজগুলো আসে সেগুলো থেকে কনটেইনার নামানো, সেগুলোকে প্লেস করা। ডেলিভারি দেয়ার যেসকল ব্যবস্থাপনাগুলো আছে সেগুলোতে তারা কিন্তু একটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে।’
এনসিটির সিংহভাগ যন্ত্রপাতি চট্টগ্রাম বন্দরের হলেও অধিকাংশই পরিচালনা করছে বেসরকারি অপারেটরের জনবল। এ ছাড়া দীর্ঘ ১৭ বছর কনটেইনার হ্যান্ডলিং ও পণ্য ডেলিভারিতে সম্পৃক্ততা নেই বন্দরের। ফলে হুট করে নেয়া এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কঠিন হবে বলে মনে করছেন বন্দরের সাবেক এই কর্মকর্তা।
চট্টগ্রাম বন্দর সাবেক সদস্য মোহাম্মদ জাফর আলম বলেন, ‘শ্রমিকের বিষয়গুলো ডিল করতো অপারেটর। এখন এই বিষয়টা যদি চট্টগ্রাম বন্দর নিজে ডিল করে তাহলে তার জন্য এটা বার্ডেন হয়ে যাবে। এই বিশাল কাজটা যদি আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তা কর্মচারির উপর দেয়া হয় এটা খুব একটা সুখকর সমাপ্তি ঘটবে না। যে জায়গায় নজর দেয়ার কথা বন্দরের কর্মকর্তা কর্মচারিদের, সে জায়গায় না দিয়ে, পণ্য হ্যান্ডেলিংয়ের জায়গায় যেটা বেসরকারি অপারেটররা করতো সে জায়গায় পুরো ফোকাস দেবে।’
বছরে প্রায় ১৩ লাখ টিইউইস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে এনসিটি। এই টার্মিনাল থেকে বছরে বন্দরের আয় এক হাজার কোটি টাকারও বেশি। জি টু জি ভিত্তিতে অত্যাধুনিক এই টার্মিনালটি দুবাইয়ের ডিপি ওয়াল্ডকে দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।