বিশাল উৎপাদন সক্ষমতার পরও পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের অনেক উদ্যোক্তা সুতা আমদানি করেন। দেশে আমদানীকৃত সুতার প্রায় ৭৫ শতাংশই ভারত থেকে আসে। চীন-পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি হলেও তা নগণ্য। গেলো অর্থবছরে বিভিন্ন দেশ থেকে ৩১ হাজার ২২৩ কোটি টাকা খরচে ৭ লাখ ৯৩ হাজার ৪৪৬ টন সুতা আমদানি হয়েছে।
আমদানি করা সুতার আধিক্যে প্রতিনিয়ত দেশে উৎপাদিত সুতার দাম কমছে। দুই মাস আগেও ২৪ কাউন্টসের কেজিপ্রতি সুতার দাম ৩ দশমিক ০৫ ডলার থেকে ৩ দশমিক ১০ ডলার পর্যন্ত উঠে। তবে বর্তমানে তা ২ দশমিক ৮ ডলারে নেমে এসেছে। ৮ শতাংশের বেশি দাম কমেছে। ২৬ কাউন্টস সুতার দাম কমেছে প্রায় ৪ শতাংশ। আর ৩০ কাউন্টস সুতার দাম ৩ দশমিক ২২ ডলার থেকে নেমেছে ৩ দশমিক ১০ ডলারে। ৩২ কাউন্টস, ৩৪ কাউন্টস ও ৪০ কাউন্টস সুতার দামও প্রায় ৪০ সেন্ট পর্যন্ত কমেছে। এতে উদ্যোক্তরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
ম্যাকসন্স স্পিনিং মিলের জেনারেল ম্যানেজার মো. হুমায়ুন কবির বলেন, 'বর্তমানে সুতার দাম কম। আমাদের প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। কারণ যে দাম দিয়ে আমরা তুলা কিনি তার চেয়ে কম দামে সুতা বিক্রি করছি। যার কারণে বাংলাদেশে স্পিনিং খাত খুব ক্ষতির মুখে আছে। যদি আন্তর্জাতিক বাজারে সুতার দাম বাড়ে তাহলে এই ব্যবসাটা টিকে থাকবে। নয়তো সামনে আমাদের মহাবিপদ।'
আন্তর্জাতিক বাজারেও সুতার দাম কমেছে। এছাড়া বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার আঁচ লেগেছে দেশের স্পিনিং খাতে। আর লোহিত সাগরে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ায় তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ কমেছে। যার প্রভাবে কমেছে সুতার দাম। অন্যদিকে টাকার অবমূল্যায়নে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। যে কারণে লোকসানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত স্পিনিং শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের ৫৮টি কোম্পানির মধ্যে ১০টি কোম্পানি বছর ব্যবধানে গেলো ২০২৩ সালে লভ্যাংশ দিতে পারেনি।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, 'যে ব্যাংকের শেয়ার ১০ টাকা নেমে গেছে তাদেরকে নিয়ে চিন্তা করে না। তারা যদি কোনভাবে বন্ধ কিংবা দেউলিয়া হয়ে যায় তখন চেয়ার-টেবিল আর এসি ছাড়া আর কিছু পাবেন না। আমি মনে করবো টেক্সটাইলকে নিয়ে হতাশার কিছু নাই। করোনার পরে আমরা ৫ থেকে ৭টা ব্যাংকের কিস্তি আগাম দিয়েছি। সুতরাং টেক্সটাইল নিয়ে আমি আশাবাদী।'
দেশে দিন দিন সুতার উৎপাদন বাড়লেও, কাঁচামালের অভাবে তা আমদানি নির্ভর। দেশের তুলার উৎপাদন বাড়ানো গেলে এই শিল্পে বাড়বে মূল্য সংযোজন। সেই সাথে বিনিয়োগের ধারা অব্যাহত রাখতে ব্যাংক এবং সরকারের নীতি সহায়তা চান খাত সংশ্লিষ্টরা।
মোহাম্মদ আলী খোকন আরও বলেন, 'আমরা বলছি মূল কাঁচামাল তুলা আনা উচিত। আর বাকিগুলো আমাদের দেশেই থেকে আসে। তাতে ডলার সংকট কমে আসবে। আমরা সব পণ্যই যদি আমদানি করে রপ্তানি করি। আর কোন কারণে যদি রপ্তানি বাজার ধরা খায় তাহলে দেনার দায় নিতে হবে।'
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, 'ভারতে সুতার দাম দেখা গেলো ৩ ডলার আর আমাদের এখানে সাড়ে তিন ডলার। তখন কিন্তু আমাদের বায়ররা দেখিয়ে দেয় ভারতে সুতার দাম কম, ঐখান থেকে নাও। তখন আমরা বাধ্য হই, কারণ বায়ররা কিন্তু ওই ৩ ডলার সুতার দাম ধরে আমাদেরকে টার্গেট মূল্য দেয়। বিশ্বব্যাপী আমরা অনেক শক্তিশালী অবস্থানে আছি। আমরা রপ্তানিকারকরা যারা আছি তাদেরকে একটু না বলতে হবে। বায়াররা যা খুশি দাম দিবে তা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে।'
আমদানী করা সুতার মূল্যের দৌঁড়ে বিভিন্ন সময়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন দেশীয় স্পিনাররা। এমন ঘটনাও আছে যে, তুলনামূলক কম দামে আমদানি করা সুতার প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অবিক্রিত থেকে গেছে কোটি কোটি টাকার সুতা। অনেক কারখানার বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সম্প্রতি সে আগুনে ঘি ঢেলেছে লোহিত সাগরের অস্থিরতা আর জ্বালানি সংকট তো আছেই। এমন অবস্থায় সুতা আমদানি বন্ধে নীতি সহায়তার পাশাপাশি বাণিজ্য সুবিধা বাড়ানোর দাবি খাত সংশ্লিষ্টদের।