দিনাজপুরের চিলিবন্দর উপজেলার দেবীগঞ্জ বাজারে মানুষের যতটুকু আনাগোনা, তা শুধু নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটার জন্য। যদিও পাড়া গায়েঁর এই বাজারটিতেও এখন এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের সুবিধা। অনেকে অবশ্য এই সুবিধা নিচ্ছেন, কিন্তু এমন অনেকেই আছেন- যারা ব্যাংকের ধারেকাছেও যান না।
রাজধানীর রিকশাচালক রুকন মিয়া। রিকশার প্যাডেল চাপিয়ে তিনি যতটুকু রোজগার করেন, তা দিয়ে প্রতিদিনকার প্রয়োজন মেটান। ব্যাংকে যাওয়ার খুব একটা দরকার হয় না এই রুকন মিয়ারও।
তিনি বলেন, 'যে কয় টাকা কামাই করি, সেটা খাওয়া-পড়াতেই শেষ হয়ে যায়। ব্যাংকে আর কী রাখমু। তাই ব্যাংকের কোনো দরকার নাই।'
রুকন মিয়ার চেয়ে ঝালমুড়ি বিক্রেতা শাহেব আলীর আয় রোজগার অনেকটা বেশি। অকপটেই বললেন, ঝালমুড়ি বিক্রি করে প্রতিদিন ১৫০০ থেকে দুই হাজার টাকার মতো আয় করেন তিনি। কিন্তু এই শাহেব আলীও সরকারের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বাইরে। ব্যাংকে হিসাব খোলার কোনো প্রয়োজনীয়তাই বোধ করেন না তিনি।
তিনি বলেন, 'কোনোদিন ১৫০০ আবার কোনোদিন ২ হাজার টাকা আয় করতে পারি। কিন্তু ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলি নাই এখনো।'
ব্যাংকে মানুষের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো যে তথ্য দিচ্ছে, তা অনেকটা চমকে উঠার মতো। সাম্প্রতিক করা আর্থ সামাজিক ও জনমিতি জরিপ বলছে, গোটা দেশের ১০ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এর বাইরে মোবাইল ব্যাংকিংসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে সারাদেশের ৪৭ ভাগ মানুষ আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায়। অর্থাৎ ৫২ শতাংশের বেশি মানুষ এখনো আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বাইরে। যারা শুধু ব্যাংক নয়, মোবাইল ব্যাংকিং কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমেই লেনদেন করেন না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (জনশুমারি ও গৃহগণনা) প্রকল্প পরিচালক মো. দিলদার হোসেন বলেন, 'যেকোনো ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সবমিলিয়ে ৪৭ দশমিক ৪৩ ভাগের অ্যাকাউন্ট আছে। আর শুধুমাত্র ব্যাংক হিসেব করলে জনসংখ্যা আছে ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ।'
সর্বশেষ অনুমোদন পাওয়া বেশ কয়েকটি নতুন ব্যাংকসহ দেশে বর্তমান ব্যাংক সংখ্যা ৬১টি। ৬৪ জেলায় সবমিলিয়ে ১১ হাজার শাখা রয়েছে ব্যাংকগুলোর। সেখানে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ মানুষের, তাহলে এতগুলো ব্যাংকের কাজ কী? প্রশ্ন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের।
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে ৬০টির মতো ব্যাংক রয়েছে। তাদের লাইসেন্স দেওয়ার জন্য যুক্তিটা দেওয়া হয়েছিল যে তারা দেশের আনাচে কানাচে সকল শ্রেণির মানুষের কাছে যাবে। সবাইকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনা হবে। এতে ব্যাংকিং খাতের অগ্রগতি হবে। কিন্তু বাস্তবে মানুষকে এ সেবার আওতায় আনা যায়নি।'
মাত্র ৫ শতাংশ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সন্তোষজনক নয়। তবে যৌক্তিক কারণেই অধিক জনগোষ্ঠীকেই ব্যাংকিং সেবার আওতায় নিয়ে আসা যায় না বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান।
তিনি বলেন, 'আমি এর শতকরা হার নিয়ে সন্তুষ্ট না। ব্যাংকের যে পরিমাণ খরচ তা সামাল দিতে গিয়ে সস্তায় অ্যাকাউন্ট খুলতে দেওয়া কঠিন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সবাইকে অ্যাকাউন্ট দিতে হলে সবার সাথে ব্যবসা করতে হবে। তাই ব্যাংকের পাশাপাশি ডিজিটাল ব্যাংকিং নিয়ে কাজ করতে হবে।'
তবে পরিসংখ্যান ব্যুরোর এই সাথে মোটেও একমত নয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তাদের তথ্য বলছে, সবগুলো ব্যাংক মিলে মোট ১৪ কোটির বেশি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ১৪ কোটির মধ্যে একজনের মানুষের তো একের অধিকও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। সেক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ের সে হিসেব কি আছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, 'সম্পূর্ণ হিসেবে ২২ কোটি অ্যাকাউন্ট আছে। এটা তিন দিয়ে ভাগ দিলেও ৭ কোটির বেশি মানুষের অ্যাকাউন্ট আছে। তার মানে ৫০ শতাংশের উপরে হবেই।'
অর্থনীতিবিদদের মতে, সাধারণ মানুষকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আনতে হলে প্রয়োজনে ব্যাংকিং সেবার সহজলভ্যতা।