অথৈ জলরাশি, ছোট ছোট আছড়ে পড়া ঢেউ, নৌকা নিয়ে নিত্যদিনের ছুটে চলা অথবা ফুটে থাকা শাপলা-শালুক বা দুরন্ত শিশুদের মাছ ধরার দৃশ্যসহ বিভিন্ন রূপে মুগ্ধতা ছড়ায় দেশের সব চেয়ে বড় উন্মুক্ত জলাশয় নাটোরের চলনবিল।
বর্ষায় পানিতে যে বিল থৈ থৈ করে, পানি কমে যাওয়ার পরই সে চলনবিল হয়ে ওঠে সবুজের গালিচা। গত কয়েক বছর ধরে পানি কম আসায় এখন এক ফসলের জায়গায়, দুই ফসল পাচ্ছেন কৃষকরা। পরিণত হয়েছে খাদ্যভাণ্ডারে। পুরো চলনবিল এখন ছেয়ে গেছে আমন ধানের সবুজ খেতে। আমন আর বোরো মৌসুম মিলে বছরে অন্তত দুই লাখ টন খাদ্য শস্যের যোগান আসছে এখান থেকে। যা টাকার অংকে অন্তত হাজার কোটি টাকা।
চলনবিলের একজন কৃষক বলেন, 'বৈশাখী ফসল এবং তার পরে আবার আমন ধানের দুইটা ফসল হয়। আগের চেয়ে এখন উন্নত এবং বেশি ফসল পাওয়া যায়। আগে আমন ধান হতো না, এখন হয়।'
চলনবিল জীববৈচিত্র রক্ষা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আকতারুজ্জামান বলেন, 'চলনবিলের আর্থ-সামাজিক অবস্থা মৎস্য এবং কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এখানকার জনগণ এই দুইটা জিনিসের ওপর নির্ভর করেই জীবন-জীবিকা পরিচালনা করে।'
পানি শুকিয়ে যাওয়ায় ধান চাষ করছেন চলনবিলের কৃষকরা। ছবি: এখন টিভি
বলা হয় মাছে ভাতে বাঙালি, এই প্রবাদ বাক্যটি যেন ধরে রেখেছে চলনবিল। মৎস্য ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত চলনবিলে মাছ ধরে জীবন চলে লক্ষাধিক পরিবারের। তবে নির্দিষ্ট সময়ে বর্ষার পানি না আসায় আগের চেয়ে কমেছে মাছের পরিমাণ। এরপরও প্রতিবছর অন্তত ২০ হাজার টন মাছের যোগান আসে চলনবিল থেকে। যার বাজার মূল্য অন্তত ৮০০ কোটি টাকা। এতে করে চলনবিল অঞ্চলের মানুষের পুষ্টির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি পরিবর্তন হচ্ছে আর্থ সামাজিক অবস্থার।
একজন জেলে বলেন, 'যখন পানি কম আসে, তখন মাছ কম হয়। এতে সমস্যা হয়। গতবারের চেয়ে এবার মাছ একটু বেশি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মাছ ছোট, এখনও বড় মাছ দেখা যায়নি।'
নাটোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, 'এ বিলের উৎপাদনের ধারাবাহিকতা সেটা আমরা ধরে রাখতে পারলে আমরা আশা করবো যে এটা আমাদের মেধানী জাতি গঠনে পুষ্টিকর খাবার সরবরাহের মাধ্যমে ভূমিকা রাখবে।'
খাদ্যশস্য এবং মাছের পর চলনবিলের অর্থনীতিতে বড় যোগান দিচ্ছে প্রাণিসম্পদ খাত। পানি কমে যাওয়ার জেগে ওঠা বিস্তীর্ণ ভূমি হয়ে ওঠে গো চারণ ভূমি। এ অঞ্চলের প্রান্তিক খামারিদের গবাদিপশুর প্রাকৃতিক খাবারের অন্যতম যোগানদাতাও চলনবিল।
এছাড়া বিলের পানিতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে হাঁস পালন করে অনেকেই হয়েছেন স্বাবলম্বী। শুধু চলনবিলেই অন্তত এক হাজার ২০০ বাণিজ্যিক হাঁসের খামার গড়ে উঠেছে।
চলনবিল জীববৈচিত্র রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, 'এই চলনবিলে যে লক্ষাধিক কৃষক রয়েছে, তারা বোরো আবাদের পাশাপাশি অন্যান্য আবাদের ওপরও তারা নির্ভরশীল। চলনবিলের কৃষি যেমন সমৃদ্ধ হচ্ছে, এখানকার কৃষকরাও উপকৃত হচ্ছে। এবং এখানে খাদ্যশস্য আরও বেশি বেশি উৎপাদন হচ্ছে।'
শুকিয়ে যাওয়া চলনবিলে গরুকে ঘাষ খাওয়াচ্ছেন একজন কৃষাণি। ছবি: এখন টিভি
নাটোর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'গবাদিপশুসহ এখানে গড়ে হিসাব করলে প্রায় হাজার কোটি টাকা বা এরও বেশি এখানে অর্থনৈতিকভাবে আসতে পারে। চলনবিল কিন্তু আমাদের লাইভস্টকের জন্য খুবই একটা ভালো জায়গা। এখান থেকে আমাদের দেশ কিন্তু দুধ, ডিম, মাংসের যোগানে এগিয়ে যেতে পারে।'
রূপ আর বৈচিত্র্যে ভরা চলনবিল বাঁচলে, বাঁচবে প্রাণ প্রকৃতি, সে সাথে বাড়বে অর্থনীতির পরিধিও। তাই চলনবিল রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান সচেতন মহলের।