পাসপোর্ট অফিসের সামনে দীর্ঘ লাইনে যারা দাঁড়িয়েছেন তাদের একটি বড় অংশই বিদেশ পাড়ি দিয়ে পরিবারের ভাগ্যের চাকা বদলে দেয়ার স্বপ্ন দেখেন। দক্ষতা অর্জনে কেউ ভর্তি হন কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। কেউ আবার দালালের মাধ্যমে পাড়ি জমান বিদেশে। অনেকে ভাগ্যের চাকা বদলাতে পারলেও অনেকের জীবনেই সুখ থেকে যায় অধরা। কষ্ট ঘামের নোনাজল শুকিয়ে যায় পরিবারের মুখভরা সুখের হাসিতে।
কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার খোশবাস গ্রামের দিনমজুর আলমাছ মিয়া ও রুবিনা আক্তারের একমাত্র সন্তান মাসুদ রানা মালদ্বীপ যান বছর ৬ আগে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে চাকরি করতো মাসুদ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মাসুদের মৃত্যুতে মাথায় হাত দিতে হয় পরিবারের। ভিটের এক টুকরো জমি ছাড়া উপার্জনের কোনো উপায় নেই পরিবারের।
রুবিনা আক্তার বলেন, 'আমরা সবাই আমার ছেলের ওপরই চলেছি। ছেলেই আমাদের খাইয়েছে। ছেলেটার ওপরই সব ভরসা আমার। আমার আর কেউ নেই।'
হতভাগ্য প্রবাসীদের অনেকেই ফিরে আসেন নিঃস্ব হয়ে। পিতা হারানো সন্তান ছোটেন আর্থিক অনুদানের জন্য। কেউ আবার নিজের জন্যও খোঁজেন বেঁচে থাকার অবলম্বন।
এক প্রবাসীর ছেলে বলেন, 'আমার বাবা বfহরাইন থাকতো। ৮ বছর থাকার পর হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা গেছেন। সরকার না কি তিন লাখ টাকা অনুদান দেবে। সেটা নেয়ার জন্য এসেছি। ওই টাকা দিয়ে পরিবারের আর্থিক অবস্থা একটু ভালো হবে।'
প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থে বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ অবকাঠামো। সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। তবে, সেই প্রবাসীদের সমস্যা দ্রুত সমাধানে সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্ব দেয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
একজন প্রবাসী বলেন, 'সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, আমরা অনেক সময়ই প্রবাসে পুলিশের হয়রানির শিকার হই। দেখা যায় কাগজপত্র সব ঠিক থাকার পরও ওনাদের মর্জি হলেই তুলে নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে অ্যাম্বাসির কোনো পদক্ষেপ নেই।'
অনেকেই দেশে ফিরে পুঁজি ভেঙে তৈরি করেন দৃষ্টিনন্দন পাকা দালান। পরিকল্পনা না থাকায় উপার্জিত অর্থ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হন প্রবাসীদের একটা বড় অংশ। দেশে ফিরেও অনেকেই কাজে লাগাতে পারেন না অর্জিত দক্ষতা ও মেধা। ফলে তাদের অনেকেই দেশে এসে মানবেতর জীবন-যাপন করেন।
শ্রমবাজারে ভালো উপার্জন করতে প্রয়োজন হয় সঠিক কর্মপরিকল্পনা। এক্ষেত্রে অভিভাবকদেরও পদক্ষেপ নিতে হবে।
কুমিল্লা জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের সহকারি পরিচালক রাহেনুর ইসলাম বলেন, 'একটা সার্ভে করে দেখা গেছে, আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার যত মানুষ বিদেশে গেছে তার ৮০ শতাংশ মানুষই প্রথম যে টাকা পায়, তারা সেগুলো নন প্রোডাক্টিভ কাজে খরচ করে।'
ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসীদের আর্থিক অনুদানে সরকারের রয়েছে নানা উদ্যোগ। নিয়ম মেনে আবেদন করলে রয়েছে আর্থিক সহযোগিতাসহ নানা সেবা। প্রবাসীদের সন্তানদের জন্য রয়েছে শিক্ষাবৃত্তি, প্রতিবন্ধী ভাতা ও সহজ শর্তে সাড়ে ৫ শতাংশ সুদে ঋণসুবিধা।
কুমিল্লা জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের জনশক্তি জরিপ কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বলেন, 'প্রথম পাসপোর্টের ভেতর বহির্গমন ছাড়পত্র থাকে। ওই ছাড়পত্র না পাওয়া গেলে প্রবাসী মারা গেলে ৩ লাখ টাকা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। ওই ছাড়পত্রটা সংরক্ষণ করতে হবে।'
চলতি বছর ৬ মাসে কুমিল্লা থেকে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন ৪৫ হাজার ৫৪৪ জন। ২০২৩ সালে বিদেশ গিয়েছে কুমিল্লার ১ লাখ ১২ হাজার কর্মী। দেশের মোট জনশক্তি রপ্তানির প্রায় ১০ শতাংশই কুমিল্লার। রেমিট্যান্স অর্জনেও কুমিল্লা দেশের অন্যতম শীর্ষ জেলা। কুমিল্লার মোট প্রবাসীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৭৬ হাজার।
দক্ষতা অর্জনে প্রবাসীদের নানারকম প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সরকার। গেল ১১ মাসে কুমিল্লা থেকে বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন করেছে ৮০ হাজার কর্মী। নিরাপদ অভিবাসনের লক্ষ্যে নিবন্ধিত ৩২ হাজার কর্মীকে দেয়া হয়েছে তিনদিনের প্রশিক্ষণ। রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়াতে উপজেলাভিত্তিক নানা কর্মসূচি নেয়ার কথা জানান জেলা প্রশাসক খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান। তিনি বলেন, 'রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি এবং দক্ষ শ্রমিক, একটি অপরটির সাথে জড়িত। আমাদের শ্রমিকরা দক্ষ হলে তাদের বেতন ভাতা থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক প্রাপ্তিগুলো বেড়ে যাবে।'