পলেস্তারাবিহীন দেয়ালের ওপর খানকয়েক টিনের এক বাড়িতে বসবাস সাহারাবাটি গ্রামের জলি পারভীনের। বাড়িটি দেখলেই বোঝা যায়, শুরু হয়েছিলো কিন্তু অর্থের অভাবে বাড়ির নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেননি জলি পারভীনের স্বামী মজনু হোসেন। সংসারের টানাপোড়েনেও ভাবিষ্যতের চিন্তায় তিনি ২০১৩ সালে সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্সুরেন্সে একটি বীমা পলিসি করেন। যেখানে বার্ষিক কিস্তি ১২ হাজার দুইশ টাকা। মৃত্যুর আগে তিনটি প্রিমিয়াম পরিশোধ করেন মজনু। নিয়ম অনুযায়ী তার নমিনি জলি পারভীনকে বীমা দাবি পরিশোধের কথা থাকলেও ৭ বছরে কোন অর্থ মেলেনি।
জলি পারভীন এখন টেলিভিশনকে বলেন, 'আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বীমা অফিসে জমা দেই। তিনমাস খুব হাটাহাটি করেছি কিন্তু টাকা না দিয়েই তারা চলে গেছে।'
এরকম ৫শ'র মতো বীমা দাবিদার আছেন মেহেরপুরে। যাদের কেউই তাদের প্রতিশ্রুত অর্থ ইন্সুরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে ফেরত পাননি। উপরন্তু কোম্পানিটি ২০১৮ সালে গাংনি থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে উধাও হয়ে যায়। গাংনি শাখায় এখন স্থান নিয়েছে অন্য অফিস। সানফ্লাওয়ারের গাংনি ব্রাঞ্চের ম্যানেজার আরিফ হোসেন এখন চাকরি নিয়েছেন অন্য একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে। তিনি জানান, 'আমরা ঊর্ধ্বতনদের সাথে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছি গ্রাহকদের পাওনা মিটানোর বিষয়ে। গ্রাহকের সংখ্যা ৫০-৬০ জন হবে।'
গত বছরের মাঝামাঝিতে নোয়াখালীতেও হাজার হাজার গ্রাহকের দাবি পরিশোধ না করেই কার্যালয় গুটিয়ে নেয়ার সময় ঘেরাওয়ের মুখে পড়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা। একই চিত্র চোখে পড়ে কুষ্টিয়াতেও।
আরেক ভুক্তভোগী সদরের কৃষক হাবিবুর রহমান। ১২ বছর পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে বছরে একুশ হাজার একশ আশি টাকা প্রিমিয়াম দিলেও ২০২০ সালে মেয়াদ পূর্তিতে বীমা দাবি আদায় নিয়ে তার রয়েছে তিক্ত অভিজ্ঞতা।
হাবিবুর রহমান বলেন, 'আমি কোম্পানির নামে বাদী হয়ে মামলা করেছি। ওয়ারেন্ট হলেও পুলিশ আসামি ধরেনি।'
টাকা উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়ে হাবিবুর রহমান আরো ১৬৯ বীমাদাবিকারীকে নিয়ে পদ্মা লাইফের চেয়ারম্যান ও এমডির বিরুদ্ধে মেহেরপুরের আদালতে মামলা করেন। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু হলেও একদিনও আদালতে হাজির করা যায়নি তাদের। এই মামলায় ভূক্তভোগীর সংখ্যা অনেক হলেও অপরিশোধিত বীমা দাবির পরিমান মোটে সাতাশ লাখ টাকার কিছু বেশি।
বাদীপক্ষের আইনজীবী আব্দুল আলিম বলেন, 'আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি থানায় কোর্টের ওয়ারেন্ট পৌঁছেছে। কিন্তু আসামি গ্রেফতার হচ্ছে না। বিজ্ঞ আদালত আসামি গ্রেফতারে তাগাদা দিবে বলে আশা করি।'
পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্সের জেলা ম্যানেজার মোস্তাকিম হোসেন বলেন, 'টাকা জমার রশিদ এবং কোম্পানির সফটওয়ারে টাকা জমা থাকার প্রমাণ থাকলেও তারা টাকা দিচ্ছেনা।'
শুধু সানফ্লাওয়ার লাইফ বা পদ্মা লাইফ নয়। বীমা দাবি পরিশোধ না করে অফিস গুটিয়ে নিয়েছে সানলাইফ, প্রগতি, প্রোগ্রেসিভ, সন্ধানী এবং হোমল্যান্ড লাইফ ইন্সুরেন্সও।
মেহেরপুরে ফারইস্ট ইসলামি লাইফ ইন্সুরেন্সের বকেয়া বিমা দাবির পরিমান সবচেয়ে বেশি, ৭ কোটি টাকার মতো। অথচ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভূক্ত এই কোম্পানির প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, এই কোম্পানিটি গত বছর দুই দফায় মোট চারটি স্থানে জমি বিক্রি করেছে, যার মূল্য ১২৭ কোটি টাকার বেশি। এই টাকাটি বীমা দাবি পরিশোধ বাবদ খরচ করার কথা।
এখন টিভির অনুসন্ধানে এই পাঁচটি বীমা কোম্পানির বকেয়া বীমা দাবি পরিশোধে নয়ছয়ের চিত্র সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাদবাকি প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য জানা না গেলেও অনেক ভুক্তভোগীর সাথে কথা হওয়ার পর এটা বলা যাচ্ছে, মেহেরপুরে যেসব মানুষ বিভিন্ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে পলিসি কিনেছিলেন, তাদের কম সংখ্যকেরই আশা পূরণ হয়েছে।
কমিশন এজেন্টরা বলছেন, 'আমরা হাজার হাজার গ্রাহক তৈরি করি। কোম্পানি টাকা না দেওয়ায় আমরা খুব সমস্যায় আছি। মানুষজন আমাদেরকে হুমকি দিচ্ছে।'
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের পরিচালক এস এম মাহমুদুল হক মুঠোফোনে বলেন, 'শুধু মেহেরপুরে নয় সারাদেশের লক্ষ লক্ষ গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই সমস্ত ইন্সুরেন্সগুলোকে বন্ধ করে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।'