সাভারের মাটি কি লাল হয়ে গেছে?
নাকি সেখানে এখনও ফুটে উঠে শিউলি ফুল?
তার রক্ত মিশে গিয়েছিল কংক্রিটের ফাঁকে,
যেন শহরের মাটিও কাঁদছিল সেদিন।
যে রক্ত শহরের মাটিতে শুকিয়ে গেছে,
সেই রক্তই একদিন ঝড় হয়ে ফিরে আসবে।
ইয়ামিনরা কখনও মরে না
বেচে থাকে মুক্ত নিশ্বাসে।
ইয়ামিনের গল্প, সাভারে পুলিশের গাড়িতে মৃতদেহ তুলে পুড়িয়ে দেয়া হয়। যাত্রাবাড়ীতে রাতভর চলে মুহুমুহু গুলি, ঝাঁঝালো বুলেটের গন্ধে রক্তের দাগ। এই দাগের একটা বড় অংশ যেন লেগে আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গায়ে। ৫ আগস্টের পর একের পর এক অভিযোগ দায়ের হয় পুলিশের সেই কর্মকর্তাদের নামে। প্রশ্ন ছিল কবে বিচার শুরু হবে এই গণহত্যার? আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ২০ নভেম্বর শুরু হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ।
এজলাসে দাঁড়িয়ে গুলশান থানার সাবেক ওসি মাঝহারুল ইসলাম হাত উঁচিয়ে, মাথা চাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন, 'আমি নির্দোষ, আমি গণহত্যার সাথে জড়িত নই, আমার ছেলে আন্দোলনে গিয়েছিল।' আর সাবেক এনটিএমসি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান বলেন, 'বাংলাদেশের মানুষ প্রযুক্তির সাথে খুব একটা পরিচিত নয় তাই তাকে ভুলভাবে তুলে ধরা হচ্ছে।'
আজ (বুধবার, ২০ নভেম্বর) আশুলিয়ার ইয়েমিন হত্যা, লাশ পুড়িয়ে দেয়া, যাত্রাবাড়ীর নির্বিচারে গুলি এমন নানা অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২৭ অক্টোবর ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল প্রসিকিউশনের আবেদন মঞ্জুর করে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আদেশ দেন।
এরপর ৩০ ও ৩১ তারিখ পরপর দুই ধাপে হাজির করা হয় পুলিশের অভিযুক্ত মিরপুরের সাবেক ডিসি জসিম উদ্দিন মোল্লা ও সাবেক অতিরিক্ত সুপার শাহিদুল ইসলামকে, তার ধারাবাহিকতায় নিয়মিত হাজিরার তারিখে আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে আনা হয় এই দুইজনসহ অভিযুক্ত আরও ছয় পুলিশের সাবেক কর্মকর্তাকে।
এজলাসে প্রথমে চিফ প্রসিকিউটর গ্রেপ্তারকৃত সকলের নাম ও তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ উল্লেখ করেন। এসময় তিনি সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে বলেন, তার নির্দেশে সারাদেশে পুলিশের বিভিন্ন বাহিনী হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। বিশেষ করে প্রসিকিউটর উল্লেখ করেন সাবেক এনটিএমসি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের নাম, তার ভাষ্যে জিয়াউল আহসানকে বাংলাদেশের বসনিয়া-হার্সেভানিয়া সাদৃশ্য কসাই উল্লেখ করে বলেন, আন্দোলনের সময় ইন্টারনেট বন্ধ, হোটাসঅ্যাপ মোবাইল ও ইমেইলসহ সব ধরনের মাধ্যম গোপনে আড়ি পাততো এই মেজর, সাথে হত্যা ও গুমের সাথেও তার সরাসরি সম্পৃক্ততা আছে। গ্রেপ্তার হওয়া এই জেনারেল দাবি করেন তিনি আয়না ঘরের সাথে সম্পৃক্ত নন।
এদিন ট্রাইব্যুনালে কাশেমপুর কারাগার থেকে প্রথম ধাপে হাজির করা হয় যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান, ঢাকা জেলার সাবেক পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল কাফি, মিরপুরের সাবেক ডিসি জসিম উদ্দিন মোল্লা, সাবেক অতিরিক্ত সুপার শাহিদুল ইসলাম, গুলশান থানার সাবেক ওসি মাজহারুল হক ও ঢাকা উত্তরের সাবেক পরিদর্শক আরাফাত হোসেনকে।
দ্বিতীয় ধাপে আনা হয় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, সাবেক এনটিএমসি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে। এজলাস থেকে বের হয়ে চিফ প্রসিকিউটর জানান, আদালতের কাছে তারা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য দুই মাসের সময় চাইলেও আদালত এক মাসের সময় আবেদন মঞ্জুর করেছেন। এবং ট্রাইব্যুনাল ন্যায় বিচারের স্বার্থে সকল পদক্ষেপ নিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
তাজুল ইসলাম বলেন, 'প্রতিটি অফিসারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট যেসমস্ত অভিযোগ ছিল, সেগুলো আমরা সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরেছি। এবং আমরা আদালতকে অবহিত করেছি যে আমরা যেসমস্ত এভিডেন্স পাচ্ছি তা তদন্ত সংস্থা বিচারের উপযোগী করে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড ফলো করে, সমস্ত ডিজিটাল এভিডেন্স, লাইভ এভিডেন্স এমনভাবে আমরা আদালতের সামনে তুলে ধরবো ক্রিস্টাল ক্লিয়ারভাবে অপরাধীরা জানতে পারবে তাদের কী অপরাধ ছিল। আমরা দু'মাস চেয়েছিলাম, আদালত এক মাস সময় দিয়েছেন এবং ১৯ ডিসেম্বর এই মামলার পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করেছেন।'
এদিন জিয়াউল আহসানের পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী ওকালত নামা দায়ের করেছেন। আদালত তা মঞ্জুর করেছেন, আদালতে দুই সপ্তাহের মধ্যে শুনানি চেয়ে তারা আবেদন করবেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। মিডিয়া ট্রায়েল থেকে বিরত থাকার অনুরোধ আইনজীবীর।
আসামিপক্ষের আইনজীবী নাজনীন নাহার বলেন, 'যেহেতু এগুলো ট্রায়ালে চলছে, কোনোটিই কিন্তু কিছু না যেটা হচ্ছে এখন। বলা হচ্ছে উনি এই করেছেন উনি সেই করেছেন কিন্তু উনি কিছুর সাথে জড়িত না।'
আগামী ১৯ ডিসেম্বর মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য করা হয়েছে। এবং তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা না দেয়া পর্যন্ত আট জনকে গ্রেপ্তার দেখাতে বলা হয়েছে।