উত্তরাধিকার সম্পত্তি ভাগাভাগিতে নতুন নিয়ম, বণ্টন হবে যেভাবে

পরিবর্তন হলো উত্তরাধিকার সম্পত্তির ভাগাভাগি পদ্ধতি, নতুন নিয়মে সম্পত্তি বণ্টন হবে যেভাবে
পরিবর্তন হলো উত্তরাধিকার সম্পত্তির ভাগাভাগি পদ্ধতি, নতুন নিয়মে সম্পত্তি বণ্টন হবে যেভাবে | ছবি: এখন টিভি
0

দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফেরাতে এবং উত্তরাধিকার সম্পত্তি নিয়ে দীর্ঘদিনের বিবাদ ও মামলা কমাতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে সরকার। এখন থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমি বিক্রি, নামজারি (Mutation) বা রেকর্ড সংশোধন করার ক্ষেত্রে 'আপোষ বণ্টননামা দলিল' (Registered Partition Deed) তৈরি করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

নতুন নিয়মের মূল দিকগুলো (Key Aspects of the New Rule)

ভূমি মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, কোনো ওয়ারিশ যদি তার হিস্যার জমি বিক্রি করতে চান, তবে অবশ্যই তাকে অন্য সকল ওয়ারিশদের সাথে একটি আপোষ বণ্টননামা দলিল সম্পাদন করতে হবে। এই দলিল ছাড়া সম্পত্তির নামজারি বা বিক্রি কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। এর প্রধান লক্ষ্য হলো ব্যক্তিগত ইচ্ছামতো জমি বিক্রি বন্ধ করা এবং সকল ওয়ারিশের সঠিক হিস্যা নিশ্চিত করা।

আরও পড়ুন:

আইনি বাধ্যবাধকতা ও শাস্তি (Legal Obligations & Punishment)

নতুন নিয়মে বলা হয়েছে, নামজারি বা রেকর্ড সংশোধনের ক্ষেত্রে মালিকানা তখনই পূর্ণতা পাবে যখন তা বণ্টননামা দলিল দ্বারা আইনিভাবে নিশ্চিত হবে। এছাড়া, ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২৩ (Land Offence Prevention and Remedy Act 2023) এর বিধিমালার অধীনে, যারা জমি কেনাবেচার সময় এই নিয়ম অমান্য করবেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

একবার এই আপোষ বণ্টননামা দলিল সম্পন্ন হয়ে গেলে তা আর বাতিল করা যাবে না, যা ভবিষ্যতে আদালতের দীর্ঘমেয়াদী মামলা (Land Dispute Litigation) থেকে রক্ষা করবে।

ভূমি মন্ত্রণালয় |ছবি: এখন টিভি

আপোষ বণ্টননামা দলিল তৈরি করতে কী কী কাগজপত্র লাগে?

আপোষ বণ্টননামা (Registered Partition Deed) দলিল তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের বিস্তারিত তথ্য নিচে দেওয়া হলো:

১. মূল দলিল বা ভায়া দলিল: সম্পত্তির মালিকানা প্রমাণের জন্য পৈত্রিক বা ক্রয়সূত্রে প্রাপ্ত মূল দলিল এবং পূর্বের ভায়া দলিলসমূহ।

২. খতিয়ান বা পর্চা: সর্বশেষ জরিপের খতিয়ান (যেমন- আরএস, বিএস বা সিটি জরিপ খতিয়ান)।

৩. হাল সনের দাখিলা (খাজনার রশিদ): ভূমি উন্নয়ন কর বা খাজনা পরিশোধের সর্বশেষ রশিদ।

আরও পড়ুন:

৪. নামজারি খতিয়ান (Mutation Khatian): উত্তরাধিকারীদের নামে জমিটি নামজারি করা থাকলে তার কপি।

৫. ওয়ারিশ কায়েম সনদ (Succession Certificate): স্থানীয় পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কর্তৃক প্রদত্ত উত্তরাধিকার সনদ, যেখানে সকল ওয়ারিশের নাম ও সম্পর্ক স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে।

৬. জাতীয় পরিচয়পত্র (NID): সকল ওয়ারিশের এনআইডি কার্ডের ফটোকপি।

৭. পাসপোর্ট সাইজ ছবি: সকল ওয়ারিশের ডিজিটাল বা ল্যাব প্রিন্ট করা ছবি।

৮. জমির নকশা বা ম্যাপ: বণ্টননামা দলিলে কে কোন অংশ পাচ্ছেন তার একটি চিহ্নিত স্কেচ ম্যাপ সংযুক্ত করা ভালো।

বণ্টননামা দলিল এখন বাধ্যতামূলক, অমান্য করলে কঠোর শাস্তি |ছবি: এখন টিভি

আপোষ বণ্টননামা দলিল তৈরিতে রেজিস্ট্রেশন ফি কত

বর্তমানে বাংলাদেশে আপোষ বণ্টননামা দলিলের রেজিস্ট্রেশন ফি জমির মূল্যের ওপর নয়, বরং নির্দিষ্ট হারে (Fixed Fee) নির্ধারিত হয়।

ফি-র ধরণফি-র পরিমাণ
রেজিস্ট্রেশন ফি৫০০ টাকা (সর্বোচ্চ)
স্ট্যাম্প শুল্ক (Stamp Duty)৫০ টাকা (সর্বোচ্চ)
ই-ফি (E-Fee)১০০ টাকা
এন-ফি (N-Fee)প্রতি পৃষ্ঠা ১৬ টাকা হারে (সাধারণত ৩০০-৫০০ টাকা হতে পারে)
এনএন-ফি (NN-Fee)নকল কাজের জন্য পৃষ্ঠা প্রতি ২৪ টাকা হারে
হলফনামা (Affidavit)৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে
কোর্ট ফি১০ টাকা

উত্তরাধিকার সম্পত্তি ভাগাভাগিতে নতুন নিয়ম, বণ্টননামা দলিল ছাড়া কেনাবেচা ও নামজারি বন্ধ |ছবি: এখন টিভি

আপোষ বণ্টননামা দলিল করার ধাপগুলো

আপোষ বণ্টননামা দলিল (Registered Partition Deed) করার প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়। নিচে সহজভাবে ধাপগুলো তুলে ধরা হলো:

১. সকল ওয়ারিশের সম্মতি ও আপোষ: বণ্টননামা দলিলের প্রথম শর্ত হলো সকল ওয়ারিশকে একমত হতে হবে। কে কতটুকু জমি পাবেন এবং জমির কোন অংশটি কার হবে (যেমন- রাস্তার ধারের অংশ বা ভেতরের অংশ), তা নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করে নিতে হবে।

২. কাগজপত্র সংগ্রহ ও যাচাই: জমির মালিকানা প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল দলিল (মূল দলিল, খতিয়ান, খাজনা রশিদ, ওয়ারিশ সনদ এবং এনআইডি) সংগ্রহ করতে হবে। কোনো কাগজে ভুল থাকলে তা আগে সংশোধন করে নেওয়া ভালো।

৩. ভূমি জরিপ ও সীমানা নির্ধারণ (Demarcation): একজন দক্ষ আমিন (Land Surveyor) দিয়ে জমিটি মেপে বণ্টন অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। দলিলে যেন প্রত্যেকের চৌহদ্দি (উত্তরে কে, দক্ষিণে কে) স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে, তা নিশ্চিত করা জরুরি। প্রয়োজনে একটি 'স্কেচ ম্যাপ' বা নকশা তৈরি করে দলিলে যুক্ত করতে হবে।

আরও পড়ুন:

৪. দলিল মুসাবিদা বা খসড়া তৈরি: একজন নিবন্ধিত দলিল লেখক (Deed Writer) বা আইনজীবীর মাধ্যমে বণ্টননামা দলিলের খসড়া তৈরি করতে হবে। এখানে প্রত্যেকের প্রাপ্ত অংশের বিবরণ এবং হিস্যা স্পষ্টভাবে লিখতে হবে।

৫. রেজিস্ট্রেশন ফি জমা (ই-পেমেন্ট): সরকার নির্ধারিত রেজিস্ট্রেশন ফি, স্ট্যাম্প শুল্ক এবং অন্যান্য ফি ব্যাংকের মাধ্যমে বা অনলাইনে জমা দিয়ে 'পে-অর্ডার' বা রশিদ সংগ্রহ করতে হবে।

৬. সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে উপস্থিতি ও স্বাক্ষর: নির্ধারিত দিনে সকল ওয়ারিশকে সশরীরে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে উপস্থিত হতে হবে। সাব-রেজিস্ট্রারের সামনে দলিলে টিপসহি বা স্বাক্ষর প্রদান করতে হবে। এরপর রেজিস্ট্রি কর্মকর্তা দলিলটি গ্রহণ করবেন এবং আপনাকে একটি রশিদ দেবেন।

৭. নামজারি বা মিউটেশন (Mutation): দলিল রেজিস্ট্রি হওয়ার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো নামজারি করা। বণ্টননামা দলিলের কপি নিয়ে স্থানীয় ভূমি অফিসে (AC Land Office) আবেদন করে নিজের নামে আলাদা খতিয়ান খুলে নিতে হবে।

বদলে গেল উত্তরাধিকার সম্পত্তি ভাগাভাগি পদ্ধতি, বণ্টন হবে যেভাবে |ছবি: এখন টিভি

অনলাইনে নামজারি (E-Mutation) করার ধাপসমূহ:

বর্তমানে বাংলাদেশে জমি কেনাবেচা বা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়ার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ই-নামজারি (E-Mutation)। নিচে অনলাইনে নামজারি করার সম্পূর্ণ নিয়ম সহজ ধাপে তুলে ধরা হলো:

১. ওয়েবসাইটে প্রবেশ: প্রথমে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট land.gov.bd অথবা mutation.land.gov.bd-এ প্রবেশ করতে হবে। সেখানে ‘অনলাইন নামজারি’ অপশনে ক্লিক করুন।

২. আবেদন ফরম পূরণ: আবেদন ফরমে জমির বিবরণ (মৌজা, খতিয়ান নং, দাগ নং), আবেদনকারীর তথ্য (নাম, ঠিকানা, এনআইডি) এবং দাতা বা পূর্ববর্তী মালিকের তথ্য সঠিকভাবে পূরণ করতে হবে।

আরও পড়ুন:

৩. প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আপলোড: আবেদনের সাথে নিচের স্ক্যান করা কপিগুলো (PDF বা JPG ফরম্যাটে) আপলোড করতে হবে:

  • মূল দলিল/ভায়া দলিল।
  • সর্বশেষ খতিয়ান (বিএস/আরএস)।
  • ভূমি উন্নয়ন কর বা খাজনার রশিদ।
  • উত্তরাধিকার সূত্রে হলে 'ওয়ারিশ সনদ' ও 'আপোষ বণ্টননামা দলিল'।
  • আবেদনকারীর পাসপোর্ট সাইজ ছবি ও এনআইডি।

৪. ফি জমা দেওয়া (পেমেন্ট): আবেদন ফি (কোর্ট ফি ২০ টাকা + নোটিশ জারি ফি ৫০ টাকা = মোট ৭০ টাকা) অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে (বিকাশ, নগদ, রকেট বা কার্ড) এর মাধ্যমে জমা দিতে হবে। পেমেন্ট সম্পন্ন হলে আপনি একটি আবেদন নম্বর (Application ID) পাবেন।

৫. শুনানি ও যাচাই: আবেদনটি ইউনিয়ন ভূমি অফিস এবং পরবর্তীতে এসি ল্যান্ড (AC Land) অফিসে যাচাই হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে আপনাকে মোবাইল এসএমএস-এর মাধ্যমে শুনানির (Hearing) তারিখ জানানো হবে। শুনানির সময় মূল কাগজপত্র নিয়ে এসি ল্যান্ড অফিসে উপস্থিত হতে হয়।

৬. চূড়ান্ত ফি ও খতিয়ান সংগ্রহ: অনুমোদন হওয়ার পর খতিয়ান ফি (১০০০ টাকা) এবং ডিডিসি ফি (১০০ টাকা) মোট ১১০০ টাকা অনলাইনে জমা দিতে হবে। এরপর আপনি ওয়েবসাইট থেকে আপনার কিউআর কোড (QR Code) যুক্ত ডিজিটাল 'নামজারি খতিয়ান' ডাউনলোড করতে পারবেন।

আরও পড়ুন:



এসআর