পাইলসের লক্ষণ, প্রতিকার ও চিকিৎসা

পাইলস বা অর্শরোগ
পাইলস বা অর্শরোগ | ছবি: এখন টিভি
0

পাইলস বা অর্শরোগ, যা ইংরেজিতে ‘হেমোরয়েড’ নামে পরিচিত, একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা। এতে মলদ্বার এবং এর নিকটবর্তী শিরাগুলো ফুলে যায় এবং প্রসারিত হয়। পরিবর্তিত জীবনযাত্রা, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস এবং অন্যান্য নানা কারণে দিন দিন এ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। চিকিৎসকদের মতে, প্রতি চারজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে প্রায় তিনজনের কোনো না কোনো সময়ে পাইলসের সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

পাইলসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত পানি পান না করা, নিয়মিত শারীরিক চিকিৎসা সম্পর্কে অবগত না হওয়ার কারণে এ রোগে ভুগতে হয় অনেক মানুষকে।

পাইলসের ধরন

পাইলস প্রধানত ২ ধরনের। বহিঃস্থ পাইলস ও অভ্যন্তরীণ পাইলস।

বহিঃস্থ পাইলস: এটি মলদ্বারের মুখে ও বাইরে থাকে। চামড়ার নিচে থাকে ও সাধারণত ব্যথা হয় না। মলত্যাগের সময় চাপ দিলে বা বেশিক্ষণ ধরে মলত্যাগ করলে বাইরের পাইলসের মধ্যে রক্ত জমাট বেধে তা শক্ত হয়ে যেতে পারে ও তাতে ব্যথা করেতে পারে। কিছুক্ষেত্রে এটি ফেটে রক্ত বের হতে পারে। অনেকদিন এ পাইলস থাকলে মলদ্বারে চুলকানি ও মলদ্বার পরিষ্কার করতে অসুবিধা হতে পারে।

অভ্যন্তরীণ পাইলস: এটি মলদ্বারের ভেতরে থাকে। এ ধরনের পাইলসের প্রধান উপসর্গ হলো মলদ্বার দিয়ে রক্তপাত ও মলদ্বার বের হয়ে আসা। এ পাইলসে ব্যথা হয় না। যদি ভেতরের পাইলস মলদ্বার দিয়ে বাইরে চলে আসে এবং ভেতরে ঢুকানো সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে ব্যথা হতে পারে।

পাইলসের কারণ

পাইলস হওয়ার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম এবং প্রধান হলো খাদ্যাভ্যাসের কারণে। আঁশ জাতীয় খাবার পরিমাণে কম খেলে পাইলস হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। এছাড়া বার্ধক্যজনিত কারণে ত্বক পাতলা হয়ে যাওয়া, পায়ুপথ সহবাস, মল পাস করার সময় অতিরিক্ত চাপ দেয়া, টয়লেট সিটে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা।

আরও পড়ুন:

এছাড়া অন্যান্য কারণের মধ্যে আছে স্থূলতা, গর্ভাবস্থা, বারবার ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়া, মলত্যাগে সবসময় চাপ দেয়া, অনেকক্ষণ ধরে মলত্যাগ করা, অনিয়মিত মলত্যাগে বা মলত্যাগের বেগ আটকে রাখার কারণেও পাইলস হয়ে থাকে। অনেকক্ষেত্রে এটি উত্তরাধিকারসূত্রে পাইলস হয়ে থাকে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ কারণগুলো অভ্যন্তরীণ পাইলসকে নিচের দিকে নামিয়ে দেয় ও বহিঃস্থ পাইলসের মধ্যে রক্ত জমাট বাধাতে অবদান রাখতে পারে। তবে কারণ যাই হোক, এতে মলদ্বারের শিরার সহন ক্ষমতা কমে যায়। ফলে শিরা প্রসারিত হয় ও শিরার প্রাচীর পাতলা হয়ে যায় এবং মলদ্বারে রক্তপাত হয়। পরে মলদ্বার নিচে নেমে আসে।

পাইলসের ঝুঁকিতে কারা

যাদের পারিবারিক ইতিহাস আছে তাদের মধ্যে পাইলস হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। বিশেষ করে কারও বাবা-মা এর যদি পাইলসে থেকে থাকে সেক্ষেত্রে সন্তানের পাইলস হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে।

এছাড়া দীর্ঘ সময় বসে থাকার কারণে এটি হতে পারে। মলত্যাগের চাপও হেমোরয়েডের কারণ হতে পারে।

পাইলসের লক্ষণ বা পাইলস হলে কী সমস্যা হয়

পাইলসে আক্রান্ত ব্যক্তির কিছু লক্ষণ আছে যেগুলো দেখে বুঝা যায় যে সে পাইলসে আক্রান্ত।

আরও পড়ুন:

মলদ্বার থেকে রক্ত পড়া, মলদ্বারে চুলকানি, মলদ্বার ফোলা ও ব্যথা, মলদ্বার ও আশপাশে যন্ত্রণাদায়ক পিণ্ড, মলত্যাগ করার সময় ও পরে অস্বস্তি হতে থাকলে বুঝতে হবে ধীরে ধীরে পাইলসের সমস্যা হওয়ার লক্ষণ এটি। এছাড়া মলদ্বার ফুলে যাওয়ার জন্য পরিষ্কার রাখতে সমস্যা হওয়া পাইলের অন্যতম লক্ষণ।

পাইলসের সমস্যায় যেসব খাবার খাওয়া নিষেধ

পাইলসের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে কিছু খাবার পরিহার করতে হয়। এসব খাবারের কারণে পাইলসের সমস্যা বেশি হয়। সেজন্য এসব খাবার থেকে বিরত থাকতে হবে। এ খাবারগুলোর মধ্যে রয়েছে— লাল মাংস, দুগ্ধজাত খাবার, তেলে ভাজা খাবার,মশলাদার খাবার, কফি ও চা।

এছাড়া অ্যালকোহল, কোমল পানীয় ও বাদাম খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

পাইলসের ঘরোয়া প্রতিকার

খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন: প্রচুর পানি পান করতে হবে। ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার বা আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে বেশি করে। এতে মল নরম হয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ হয়।

নারকেল তেল: নারকেল তেল দিলে পাইলসের লক্ষণ থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।

সিটজ বাথ: গরম জল দিয়ে একটি সিটজ বাথ নেয়া ফোলাভাব কমাতে এবং ব্যথা উপশম করতে সাহায্য করে।

কোল্ড কম্প্রেস: আক্রান্ত স্থানে ঠান্ডা প্যাক লাগালে ফোলা এবং ব্যথা কমে।

পাইলসের চিকিৎসা

উপরের কাজগুলো করার পরও যদি পাইলসের সমস্যার সমাধান না হয় তাহলে রোগীকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

এরপরও কোষ্ঠকাঠিন্য পরিহার করা, মলত্যাগে অতিরিক্ত চাপ না দেয়া, বেশিক্ষণ ধরে মলত্যাগ না করলে রক্তপাত ও মলদ্বার বের হয়ে আসা প্রতিরোধ করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন:

ওপরের নিয়ম মেনে চললে বহিঃস্থ পাইলসের ব্যথা ও ফোলা কয়েকদিনের মধ্যে কমে যেতে পারে। তবে পুরোপুরি ফোলা সেরে উঠতে চার থেকে ছয় সপ্তাহ সময় লাগে। এতে করেও যদি সমস্যা থেকে যায় সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অপারেশন প্রয়োজন হতে পারে।

এছাড়া আরও কিছু চিকিৎসা রয়েছে এ রোগের জন্য। সেগুলো হলো—

ব্যান্ড লাইগেশন: এটি পাইলসের একটি কার্যকারী চিকিৎসা। ব্যান্ড লাইগেশনের মাধ্যমে পাইলসের ওপরে একটি ব্যান্ড পড়িয়ে দেয়া হয়। ফলে পাইলসের রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। পরে পাইলস ও ব্যান্ড ঝরে পরে যায়। ১-২ সপ্তাহের মধ্যে ঘা শুকিয়ে যায়। এ চিকিৎসার পর কিছুক্ষেত্রে রক্ত যেতে পারে ও মলদ্বারে অস্বস্তি হতে পারে। ব্যান্ড লাইগেশন দুই থেকে তিনবার করতে হয়।

ইনজেকশন এবং ইনফ্রারেড চিকিৎসা: যে পাইলস মলদ্বারের বাইরে বের হয়ে আসে না সেসব ক্ষেত্রে এ চিকিৎসা করা যেতে পারে। এ চিকিৎসা সম্পূর্ণ ব্যথা মুক্ত।

কেটে পাইলস অপারেশন: পাইলস রোগের সবচেয়ে কার্যকরী অপারেশন। এক্ষেত্রে পাইলস সম্পূর্ণভাবে কেটে ফেলা হয়। যখন ব্যান্ড লাইগেশন করা বা ইনজেকশন দেয়ার পর পাইলস আবারও হয় বা যদি অনবরত রক্তপাত হতে থাকে বা পাইলস যদি ভেতরে ঢুকানো সম্ভব না হয়, তাহলে কেটে পাইলস অপারেশন করতে হয়। বহিঃস্থ পাইলসের ভেতরে বার বার রক্ত জমাট বেধে গেলে পাইলস অপারেশন করে ফেলতে হবে। পাইলস অপারেশনে যে অংশ বের হয়ে আসে ও যা থেকে রক্তপাত হয় তা অপসারণ করা হয়। এটি অবেদন করে করা হয়, কিছু ক্ষেত্রে এক থেকে তিন দিন হাসপাতালে থাকতে হয়।

লংগো অপারেশন: এটি পাইলস অপারেশনের একটি প্রক্রিয়া। এখানে একটি বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ পাইলস কেটে নিয়ে আসা হয়। ফলে বহিঃস্থ পাইলসে রক্ত সরবরাহ কমে যায় এবং তা সংকুচিত হয় যায়। এখানে যন্ত্রের মাধ্যমে কাঁটা ও জোড়া লাগান হয়। একটি যন্ত্র দিয়ে একজন রোগীর অপারেশন করা যায়। সেজন্য এ অপারেশন ব্যয়বহুল। এ অপারেশনের পর রক্তপাত বা পাইলস বের হয়ে আসে না। অপারেশনের পর সিজ বাথ বা ড্রেসিং এর দরকার হয় না। ক্ষতস্থান হতে রক্ত বা রক্তপানি বের হয়না। এক্ষেত্রে অপারেশনের তিন থেকে চার দিনের মধ্যে কাজে যোগদান করতে পারে রোগীরা।

আরও পড়ুন:

টি এইচ ডি অপারেশন: পাইলসের অত্যাধুনিক অপারেশন এটি। এ অপারেশনে পাইলস কাঁটা হয় না। একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাইলসে রক্ত সরবরাহকারী ধমনী বন্ধ করে দেয়া হয় ও মলদ্বারের যে অংশ নিচে নেমে আসে সে অংশকে তার স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এ অপারেশনে ব্যথা কম থাকে, সিজ বাথ বা ড্রেসিং দরকার হয় না।

পাইলস থেকে চিরতরে মুক্তির উপায়

সাধারণত নিয়মিত খাবার ও খাদ্যাভ্যাসের ওপরই পাইলসের রোগ নির্ভর করে। সেজন্য খাদ্যাভ্যাস ঠিক থাকলে এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে কম।

ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার: প্রতিদিনই শাক সবজি, ফলমূল, মটরশুঁটি ও ডাল ইত্যাদি খাবার খাওয়া। ফাইবারযুক্ত খাবার খেলে পায়খানা স্বাভাবিক থাকে এবং পাইলস থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

পানি পান বৃদ্ধি: প্রতিদিন প্রয়োজনমত পানি পান করতে হবে। পাইলসের চিকিৎসায় অন্যতম জরুরি বিষয় হলো প্রচুর পানি পান করা। চা-কফি ও কোমল পানীয় পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

আরও পড়ুন:

ইসবগুলের ভুসি: প্রতিদিন সকালে নিয়মিত ইসবগুলের ভুসি পানিতে মিশিয়ে পান করলে পায়খানা স্বাভাবিক থাকে। ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য ও পাইলস থেকে মুক্ত থাকা যায়। বেশি পরিমাণে ইসবগুলের ভুসি খেলে পেটে গ্যাসের সমস্যা ও ব্যথা হতে পারে। সেজন্য প্রয়োজনমত খেতে হবে।

খাঁটি ঘি: অনেকের ধারণা প্রতিদিন পরিমাণগত ঘি খেলে পাইলস থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তবে এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

টয়লেটে কম সময় ব্যয়: টয়লেটে গিয়ে অনেকে প্রচুর সময় ব্যয় করা উচিত নয়। স্বস্তি মেলে এ পরিমাণ পায়খানা হয়ে গেলে টয়লেট থেকে বের হয়ে যাওয়া উচিত।

এসএস