থাইরয়েডের সমস্যা হলে হরমোনের উৎপাদন অতিরিক্ত (হাইপারথাইরয়েডিজম) বা অপর্যাপ্ত (হাইপোথাইরয়েডিজম) হতে পারে। এজন্য বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়।
থাইরয়েড গ্রন্থির কাজ
থাইরয়েড গ্রন্থির কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হচ্ছে শরীরের বিপাক প্রক্রিয়ার হার নিয়ন্ত্রণ করা, হৃদস্পন্দনের হারকে প্রভাবিত করা, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করা।
এছাড়াও শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখা, পেশী এবং হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় সাহায্য করা, মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করা থাইরয়েড গ্রন্থির কাজ।
থাইরয়েড সমস্যার লক্ষণ
থাইরয়েডের সমস্যার নানা লক্ষণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম ক্লান্তি ও মেজাজের পরিবর্তন হয়, হঠাৎ ওজন বেড়ে যায় বা কমে যায়, ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়।
এছাড়া নারীদের ক্ষেত্রে অনিয়মিত মাসিক দেখা দেয়। হজমের সমস্যা, ত্বকের পরিবর্তন, শরীরের তাপমাত্রা পরিবর্তনের অনুভূতি থাইরয়েডের সমস্যার অন্যতম লক্ষণ।
বংশগত কারণ, আয়োডিনের অভাব, শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা।
থাইরয়েডের রোগ
থাইরয়েড রোগ সাধারণত থাইরয়েড গ্রন্থিকে সঠিক পরিমাণে হরমোন তৈরি করা থেকে বিরত রাখে। থাইরয়েড গ্রন্থিতে খুব বেশি থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন হলে শারীরিক বিপাকীয় প্রক্রিয়া প্রভাবিত হয়। এ অবস্থায় শরীর খুব দ্রুত শক্তি ব্যবহার করে। একে হাইপারথাইরয়েডিজম বলে।
খুব দ্রুত শক্তি ব্যবহার করার ফলে হাইপারথাইরয়েডিজমে শরীরে ক্লান্তি অনুভূত হয়। এছাড়াও হৃৎস্পন্দনের হার বেড়ে যাওয়া, দ্রুত ওজন কমে যায়।
এর বিপরীতে যখন থাইরয়েড গ্রন্থি খুব কম থাইরয়েড হরমোন তৈরি করে অর্থাৎ হাইপোথাইরয়েডিজম হয়, তখন শরীরে শ্রান্তি আসে। ওজন বেড়ে যায়, ঠান্ডা তাপমাত্রা সহ্য হয় না, ডিপ্রেশন বাড়ে, ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়।
থাইরয়েডের রোগ বিভিন্ন অবস্থার কারণে হতে পারে। এগুলো পারিবারিক বা জিনগতভাবেও হতে পারে।
হাইপারথাইরয়েডিজম
হাইপারথাইরয়েডিজম গ্রেভস রোগের দিকে পরিচালিত করতে পারে। যার অনেকগুলি লক্ষণ রয়েছে। যেমন বেশি ঘাম হওয়া, অ্যারিথমিয়া (অনিয়মিত হৃদস্পন্দন), ওজন কমে যাওয়া, চোখ প্রসারিত হওয়া এবং নার্ভাসনেস।
হাইপোথাইরয়েডিজম
হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষণগুলির মধ্যে ক্লান্তি, ওজন বেড়ে যাওয়া, বিষণ্ণতা, অস্বাভাবিক হাড়ের বিকাশ এবং স্থবির বৃদ্ধি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো অটোইমিউন। অ্যান্টিবডির উৎপাদন যা থাইরয়েড গ্রন্থি আক্রমণ করে।
হাশিমোটো-এর থাইরয়েডাইটিস
হাশিমোটো-এর থাইরয়েডাইটিস, একটি অটোইমিউন ডিসঅর্ডার, থাইরয়েড গ্রন্থির প্রদাহ। এটি গলগণ্ড (ঘাড় ফোলা) এবং অন্যান্য উপসর্গের কারণ হতে পারে।
থাইরয়েড টিউমার
থাইরয়েড নডিউলস্ এবং অ্যাডেনোমাস, ছোট, ক্যান্সারহীন বৃদ্ধি, কোষের স্তরে শুরু হয় যা থাইরয়েড গ্রন্থির অভ্যন্তরীণ পৃষ্ঠকে রেখা দেয়। অ্যাডেনোমা নিজেই থাইরয়েড হরমোন নিঃসরণ করতে পারে এবং হাইপারথাইরয়েডিজম হতে পারে। থাইরয়েড অ্যাডেনোমা চিকিৎসার মধ্যে অতিরিক্ত সক্রিয় নোডিউল অপসারণের জন্য অস্ত্রোপচার অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
থাইরয়েড ক্যান্সার
যাদের মাথা, ঘাড় বা বুকে বিকিরণ বা রেডিয়েশন দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে থাইরয়েড ক্যান্সার বেশি দেখা যায়। যাদের কোনো পরিচিত ঝুঁকির কারণ নেই এটি তাদের মধ্যেও ঘটতে পারে।
থাইরয়েড ক্যান্সারের চারটি প্রধান প্রকার রয়েছে। প্যাপিলারি থাইরয়েড ক্যান্সার, ফলিকুলার থাইরয়েড ক্যান্সার, অ্যানাপ্লাস্টিক থাইরয়েড ক্যান্সার এবং মেডুলারি ক্যান্সার। বেশিরভাগ থাইরয়েড ক্যান্সারের সফলভাবে চিকিৎসা করা সম্ভব।
যাদের থাইরয়েড রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি
যাদের থাইরয়েড রোগের পারিবারিক ইতিহাস আছে, রোগটি উত্তারাধিকার সূত্রে পাবার সম্ভাবনা আছে অর্থাৎ জিনগতভাবে এ রোগ হতে পারে।
রক্তাল্পতা, টাইপ-১-ডায়াবেটিস, প্রাথমিক অ্যাড্রিনাল অপ্রতুলতা, লুপাস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, সজোগ্রেনের সিন্ড্রোম এবং টার্নার সিনড্রোম রোগগুলোর মধ্যের যেকোনো একটির ইতিহাস আচে তাদের মধ্যে ঝুঁকি বেশি।
বেশি আয়োডিনযুক্ত এমন ওষুধ সেবন করার কারণে হতে পারে। ষাটোর্ধ্ব মানুষের থাইরয়েড হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়া আগে থাইরয়েড অবস্থা বা ক্যান্সারের জন্য চিকিৎসা করা হয়েছে তাদের এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
চিকিৎসকের পরামর্শ
যে চিকিৎসক থাইরয়েড রোগের চিকিৎসা করেন তাকে বলা হয় এন্ডোক্রিনোলজি ডাক্তার। কিছু লক্ষণ দেখা দিলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
গলার ভয়েস বক্সের দুইদিকে ফোলা পিণ্ডের মতো অনুভব করলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
হতাশা, নার্ভাস অনুভব করা, ডিপ্রেশন, অথবা মেজাজ পরিবর্তন হলে। অনেকক্ষণ ধরে গরম অথবা শীত অনুভূত করলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
খুব বেশি শ্রান্তি অনুভব করলে ও হঠাৎ ওজন কমা বা বেড়ে যাওয়ার সমস্যা দেখা দিলে।
থাইরয়েড ব্যাধি প্রতিরোধের উপায়
প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এড়িয়ে চলা: প্রক্রিয়াজাত খাবারের অনেক রাসায়নিক থাইরয়েড হরমোন তৈরিকে প্রভাবিত করতে পারে। যেকোনো ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এড়িয়ে চলতে হবে। এসব খাবারে লবণ, চিনির ও তেলের পরিমাণ বেশি থাকে। যা ওজন দ্রুত বাড়াতে পারে।
ক্রুসীফেরাস সবজি: থাইরয়েড থাকলে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকোলি আর পালংশাক একেবারেই এড়িয়ে চলতে হবে কারণ এ সবজিতে গয়ট্রোজেন থাকে যা থাইরয়েড গ্রন্থির আয়োডিন শোষণে বাধা দেয় এবং হাইপারথাইরয়েডিজমকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
সয়া পণ্য এড়িয়ে চলা: সয়া খাওয়া সীমিত করতে হবে। কারণ এটি থাইরয়েড হরমোন তৈরিকে প্রভাবিত করে। সেজন্য সয়াবিন, সয়ার দুধ, টফুর মতো খাবার মেপে খাওয়াই ভালো।
ধূমপান বন্ধ করতে হবে: ধূমপানের সময় নির্গত টক্সিন থাইরয়েড গ্রন্থিকে বেশি সংবেদনশীল করে তুলতে পারে যা থাইরয়েড রোগের কারণ হতে পারে।
মানসিক চাপ কম করতে হবে: থাইরয়েড রোগসহ অনেক স্বাস্থ্য ব্যাধিতে মানসিক চাপের অবদান হলো অন্যতম প্রধান। সেজন্য মানসিক চাপ কমাতে ধ্যান, যোগব্যায়াম করতে হবে এবং যথেষ্ট পরিমাণ ঘুমাতে হবে।





