0

সেন্টমার্টিন ভ্রমণ: অত্যাচার না কি স্বেচ্ছাচারিতা?

সেন্টমার্টিন নিয়ে নানা ধরনে খবর ছড়িয়ে পড়ছে কয়েক বছর ধরে। তারমধ্যে একটি- সেন্টমার্টিনে পর্যটক যাওয়া 'বন্ধ' হবে কি হবে না? নানা ধরনের সংশয় আর উৎকণ্ঠার মাঝে হঠাৎই আগুনে পুড়ে যায় দ্বীপের তিনটি অবকাশযাপন কেন্দ্র। ঢাকায় বসে এবং ফেসবুক ঘেঁটে অনেকেই পেলেন এর মাঝে ষড়যন্ত্রের গন্ধ। ষড়যন্ত্র আছে কি নেই? সেটা জানতে হলে সরেজমিনে ঘুরে আসতে হবে সেন্টমার্টিন। চলুন ঘুরে আসি।

দাপ্তরিক অবকাশে অন্তত চল্লিশ জন পর্যটক যাত্রা শুরু করে ঢাকা থেকে সেইন্ট মার্টিন। ঠিক সময়মতো কক্সবাজারের নুনিয়ারছড়ার বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে পৌঁছে যাই। সাড়ে আটটার মাঝে কেয়ারি সিন্দবাদ নামের জাহাজটি ছেড়ে যাবার কথা। উল্লেখ্য, ২০০৪ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত টেকনাফের দমদমিয়া জাহাজঘাট থেকে সেন্টমার্টিনে পর্যটক পরিবহন করেছিল কেয়ারি।

প্রথম বিপত্তি, ঘাটের লোকজন জানায়, জাহাজ-লঞ্চ বা স্টিমার যাই বলি না কেনো, সেটা ছাড়বে সকাল ৯টার পর। ফলে বিশাল নারী পুরুষের আমাদের দলসহ আরও অনেকেই ঘাটের অদূরে চায়ের দোকানে সময় কাটাতে থাকে। নির্দিষ্ট সময়ে শোনা যায় কেয়ারি সিন্দবাদ আমাদের ছেড়ে চলে গেছে! চল্লিশজন টিকিট কাটা যাত্রী ফেলে একটি জাহাজ চলে গেছে।

কারণ? কারণ হলো, স্থানীয় অপেক্ষমাণ যাত্রী আসায় জাহাজের লোকেরা মনে করেছেন জাহাজ পরিপূর্ণ, তাই তারা কোনো ফোন না করে চলে গেল। এরপর ম্যাজিস্ট্রেট ডেকে এনে জাহাজ আবার ঘাটে ফিরিয়ে আনা হয়। মাত্র পাঁচ হাজার টাকার মুচলেকা এবং জীবনের দু'টি ঘণ্টার যাচ্ছেতাই অপচয়ে আমরা উঠলাম জাহাজে।

প্রথমেই আসি জাহাজে উঠা নিয়ে। তারা সরাসরি জেটিতে জাহাজ ভেড়ান না। শুধু প্রথমে যে জাহাজ আসে সেটি মাটি পায়, পরের টা প্রথমটার সাথে যুক্ত হয়- এভাবে চার-পাঁচটা এক সঙ্গে বাঁধা থাকে। যাত্রীও সেভাবে উঠে। আগে প্রথম জাহাজের লোক উঠে। এরপর দ্বিতীয়- সবার শেষে সবার পরেরটা। তাহলে যাত্রীরা কীভাবে যায়? জাহাজের ভেতর দিয়ে ডেকে উঠে, সিঁড়ি দিয়ে উঠে আবার কখনও নেমে শেষ জাহাজে পৌঁছাতে হয়। একটা জাহাজ থেকে আরেকটা জাহাজে যাবার জন্য রয়েছে অনিরাপদ কাঠের পাটাতন।

এভারে ভিরের মধ্যে একটা জাহাজ থেকে আরেক জাহাজে যেতে হয়।

সেন্টমার্টিনকে বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর জায়গা বলা হয়। যেটা নিয়ে গর্ব করি। সবাই চায় পর্যটকরা সেখানে ভ্রমণ করুক, বিদেশিসহ। অথচ স্মুথলি একজন পর্যটককে জাহাজে উঠা নিশ্চিত করতে পারছি না। এখানে কারও হাতে বড় ব্যাগ থাকতে পারে। কারো বয়স কম বা বেশি হতে পারে, কারও সিঁড়ি চড়তে ভয় বা অপারগতা থাকতে পারে। এই সকল মূল বিষয়ের প্রতি কারো নজর নেই। হয়তো ভাবনাতেও নেই।

এবার জাহাজের অবস্থা নিয়ে বলি। টয়লেটে পা রাখার অবস্থা নেই। তার সামনে যারা বসেছে অন্তত দুই তিন সারি অব্দি যে পরিমাণ দুর্গন্ধ সহ্য করতে হয়েছে, তা বলে বোঝানোর কোনো ভাষা নেই। টিপ বিস্কুট বা মেশিন কফি ছাড়া আর তেমন কিছু নেই খাবারের আয়োজন। তবে অর্ডার দিয়ে রাখলে তারা খাবার বানিয়ে রাখেন। কিন্তু জাহাজের হাল দেখে সেই জাহাজের খাবার খাবেন কি না- সেটাও হতে পারে গবেষণার বিষয়।

মোটামুটি বিকাল পাঁচটা অবধি অনেকেই বিন্দুমাত্র পানি পান না করে, প্রেশার সামলে দ্বীপে পৌঁছাই। এবার নামার পালা, কিন্তু সেখানেও ওঠার মতো একই রকমের বিড়ম্বনা। অন্য জাহাজের ভেতর দিয়ে- হাজারও মানুষ ঠেলে অবশেষে জেটিতে পা রাখা। যে জাহাজ দুপুরের পর পৌঁছানোর কথা, সেটি ঘাটে ভিড়ে প্রায় সন্ধ্যায়। পর্যটকদের পুরো দিনটাই মাটি।

সেন্টমার্টিন একটি দারুণ সৌন্দর্যময়ী দ্বীপ। পর্যটক বান্ধব এবং নিরাপদও। আমি দু'তিনটি মেয়ের দল দেখেছি, যারা গভীর রাত পর্যন্ত সৈকতে বসে জোৎস্না উপভোগ করছে, মজা করছে, গান গাইছে। নিরাপদ মনে হয়েছে শতভাগ। রিসোর্টগুলোর মানুষ ব্যবসায়িক কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে ভালো। কেউ কাউকে বিরক্ত করছে- তা আমার চোখে ধরা পড়েনি। খাবার ভালো। যদিও আরেকটু ভেরিয়েশন দরকার।

সেন্টমার্টিনে ভাসছে নৌকা।

বাংলাদেশের মানুষ এখন বিভিন্ন দেশে যায়, ফলে যা খুশি তাই রান্না করে পরিবেশন করার মনোভাব থেকে বের হয়ে আসতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে আইনশৃঙ্খলার মানুষ ছিল চারপাশে। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিরাপদবোধ করেছি। আর তিনটি রিসোর্ট পুড়ে যাবার প্রভাবও চোখে পড়েনি।

এবার ফেরার পালা। জাহাজ ঘাটে থাকার কথা তিনটায়। আসার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, চারটার আগে আসবে না। তারপরেও ঠিকই পৌঁছে গেলাম আগে ভাগে। জাহাজও এলো চারটার মাঝেই। কিন্তু সেই এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে এবং সিঁড়ির খেলা শুরু হলো। জেটি ভর্তি মানুষ বাক্সপেট্রা নিয়ে অপেক্ষমাণ জাহাজের দিকে ছুটছে। একটার পিছে একটা জাহাজ নোঙর করা, ট্রেনের বগির মতন। আগে সবাই নামবে তারপর সিরিয়াল অনুযায়ী একটা একটা জাহাজ ভর্তি হবে। এর মাঝে আরেকটা বড় জাহাজ জেটিকে ধাক্কা দিয়ে এসে থামলো। জেটি ক্ষতিগ্রস্ত। তাতে কি? সরকারি মাল দরিয়াপে ঢাল।

একটু ভাবুন তো, একজন মানুষ কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে বড় ব্যাগ কাঁধে বা পিঠে নিয়ে? আবার হাজারও মানুষের ধাক্কাধাক্কি, হুড়াহুড়ি। বয়স্ক বা বাচ্চারা কী নাজেহাল হয়! ৩টার জাহাজ ছাড়লো সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে।

ফেরার পথেও সেই গন্ধকে সঙ্গী করে রাত ১২টার পরে এসে পৌঁছাই কক্সবাজারে। নামার সময় অস্থির, মানুষের ধাক্কাধাক্কি-চাপ শুরু হয়। চার-পাঁচটা জাহাজ পার হওয়া আর শেষের মইটা দিয়ে নামা চ্যালেঞ্জিং। কারণ একে তো খাড়া- তার উপর পাদানি ভিতরের দিকে। পিছলে গেলে নির্ঘাত পানিতে, অতঃপর হাসপাতাল। প্রায় দুই ঘণ্টা স্ট্রাগলের পর কক্সবাজার ঘাটে নামতে পারি।

ঘাট-জাহাজ-জেটির অনিয়ম, বাজে আচরণ, যাত্রীদের প্রতি অনীহার কারণে এই দ্বীপের ব্যবসা তো ভেঙে পড়বেই। সঙ্গতকারণে দ্বীপবাসীও যে বিপদে পড়বেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারও যেন কোনো দায়বদ্ধতা নেই।

তাহলে মানুষ কেন পয়সা খরচ করে অত্যাচারিত হবে এই দ্বীপে বেড়াতে যাবার পথে? এটা কি তবে কক্সবাজার বা অন্য কোনো পর্যটন নগরীর কূটচাল? সেইন্ট মার্টিনকে বসিয়ে দেবার জন্য। এটাও ভাবতে হবে। আমার মনে হয়েছে, পাসপোর্ট-ভিসা এসব ধোয়া তুলে বিআইডব্লিউটিএ'র স্বেচ্ছাচারিতাকে লুকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। যেন মানুষ অন্য বিষয়ে ব্যস্ত থাকে।

অথচ এই একটা দ্বীপের অন্তত যাতায়াতটা ঠিক করে দিলে, এটা দিয়েই হয়তো বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হয়ে যেতে পারতো। কারণ যে ঢেউ আছে সেন্টমার্টিনের বুকে সেটি তো অন্য কোথাও নেই। কী অবহেলা! কী অপচয়! দেশের মানুষের প্রতি কি অবজ্ঞা। দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতি তাচ্ছিল্য!

সকল পর্যটকের উচিত এই দ্বীপকে বয়কট করে চাপে ফেলা। তাহলে ব্যবসায়ীরা চাপে পড়বে, যাতায়াত ব্যবস্থা ঠিক করবে। জানেন তো, চাপে না ফেললে কোনো কিছু বদলায় না?

লেখক- সৈয়দা ফারজানা জামান রূম্পা

এসএস