মধ্যপ্রাচ্য
বিদেশে এখন
0

আসাদ পতনের পর সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা

আসাদের পতনের পর সিরিয়ার ভবিষ্যৎ কী? কার হাতে যাবে দেশের নেতৃত্ব? বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়া এইচটিএসের প্রধান জোলানিই কি শেষ পর্যন্ত বসবেন দামেস্কের মসনদে? জঙ্গি সংগঠন থেকে দেশের অন্যতম প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়া এইচটিএসকে নিয়ে আঞ্চলিক শক্তিগুলোই বা কী ভাবছে?

বাশার আল-আসাদ আত্মগোপনে গেছেন আগেও। গেল সপ্তাহে আলেপ্পো বিদ্রোহীদের দখলে চলে যাওয়ার ঘটনাও নতুন নয়। ২০১১ সাল থেকে শুরু হওয়া দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে ২০১২ সালে আলেপ্পো, ২০১৩ সালে রাক্কা আর ২০১৫ সালে ইদলিবে খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছিল আসাদ বাহিনী, কিন্তু রাজধানীতে তার সিংহাসন ছিল অক্ষত।

এবার দৃশ্যপট একটু আলাদা। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় এবারের পতন যেমন অপ্রত্যাশিত, তেমনি নজিরবিহীন। সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ শহর ও সাবেক শিল্পাঞ্চল হিসেবে আলেপ্পো হারানোর অর্থ বড় মাশুল গোনা। ২০১২ সাল থেকেই পশ্চিমা শক্তির ওপর নির্ভর করে ক্ষমতা আঁকড়ে ছিলেন আসাদ। বড় ক্ষয়ক্ষতি আর চার বছর অবরুদ্ধ থাকার পর তার সেনাবাহিনী আলেপ্পোর নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়। ক্লান্ত আট বছর পর গেল সপ্তাহে ফের আলেপ্পোর পতন থেকেই শুরু হয় আসাদ সরকারের বিদায়ের ক্ষণগণনা, যাতে যোগ দিয়েছে যুগ পেরোনো গৃহযুদ্ধ আর জাতীয় অর্থনীতিতে ধসে ক্লান্ত সাধারণ জনতাও।

সিরিয়া, দ্য আটলান্টিক কাউন্সিলের রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো কুতাইবা ইদলবি বলেন, ‘২০১১ সালে যা দেখেছি, তার সাথে মিল আছে এখনকার ঘটনাপ্রবাহের; যেখানে মূলত স্থানীয়রা, সাবেক সশস্ত্র গোষ্ঠী আর দেশের তরুণরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে শাসকদলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য। পার্থক্য হলো- এবার মানুষ শাসকদলের হাত থেকে নিস্তার পেতে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’

আসাদ বাহিনীর দুর্বলতার কারণ হিসেবে উঠে আসছে ২০১৬ সালে আসাদকে আলেপ্পো পুনর্দখলে সাহায্য করা হিজবুল্লাহ আর রুশ সেনাদের অনুপস্থিতি। লেবাননে যুদ্ধে বিধ্বস্তপ্রায় ইরানসমর্থিত হিজবুল্লাহ, আর রুশ সেনারা ইউক্রেনে যুদ্ধে যোগ দেয়ায় সিরিয়ায় সম্প্রতি অবস্থান বেশ দুর্বল ছিল দুটি পক্ষেরই। কিন্তু মিত্রদের সহযোগিতা না পেলেও হায়াত তাহরির আল-শাম, তথা এইচটিএস নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ন্যূনতম প্রতিরোধও থাকবে না আসাদ বাহিনীর, এমনটা ছিল কল্পনাতীত।

সিরিয়া, দ্য আটলান্টিক কাউন্সিলের রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো কুতাইবা ইদলবি বলেন, ‘আসাদ সরকার কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। কারণ একদিকে রাশিয়া ইউক্রেনে বাঁধা পড়ে আছে। লাটিাকিয়ার বিমানঘাঁটি থেকে দিনে আগে গড়ে ২৫টি বিমান উড়লেও সম্প্রতি তা পাঁচ-ছয়ে নেমে আসে; যা সারা সিরীয় সেনাবাহিনীর পতন ঠেকাতে কোনো অবস্থাতেই পর্যাপ্ত ছিল না। অন্যদিকে ইরানও শাসকগোষ্ঠীকে পর্যাপ্ত সুরক্ষা দিতে অক্ষম ছিল।’

আন্তর্জাতিকভাবে দীর্ঘদিন কোণঠাসা থাকার পর সম্প্রতি আসাদের জন্য পরিস্থিতি সম্প্রতি অনুকূলেই যাচ্ছিল। সিরিয়াকে গেল বছর সদস্যপদ ফিরিয়ে দেয় আরব লীগ। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিলের বিনিময়ে দেশ ছেড়ে পালানো শরণার্থীদের আসাদ ফিরিয়ে নেবেন, এমন প্রত্যাশায় ইতালিসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ সিরিয়ার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্বহাল করে। ৩০ লাখের বেশি সিরীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়া প্রতিবেশী তুরস্কও চেয়েছিল একই ধরনের চুক্তি।

যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উপকূলের দিকে ঠেলে দিয়ে সিরিয়ার ভেতরে আঙ্কারার জন্য উচ্চ সুরক্ষিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অনুরোধ আসাদ প্রশাসন ফিরিয়ে দিলে থমকে যায় আলোচনা। প্রতিবেশী দেশে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ, সীমান্তে বিচ্ছিন্নতাবাদ- সবমিলিয়ে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে তুরস্কের। এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়া-হিজবুল্লাহর অনুপস্থিতির সুযোগ লুফে নিয়ে সিরিয়ার উত্তরপূর্বাঞ্চলে তুরস্কের মদদপুষ্ট আসাদবিরোধী বিদ্রোহীদের নাটকীয় উত্থান।

আসাদ পরিবারের পাঁচ দশকের শাসনের অবসানে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বিদ্রোহীদের উচ্ছ্বাসে যোগ দিয়েছে দেশের সাধারণ মানুষও। কিন্তু বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়া এইচটিএস এককালে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সাথে সম্পৃক্ত ছিল বলে তাদের উত্থানে বাড়ছে শঙ্কাও। বহুমুখী সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রও জড়াবে কি না, উঠছে সে প্রশ্নও।

সিরিয়া দ্য আটলান্টিক কাউন্সিলের রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো কুতাইবা ইদলবি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র কখনোই চাইবে না যে কোনো ইসলামপন্থি সংগঠনের হাতে চলে যাক পুরো সিরিয়া। কিন্তু সিরিয়ার পরবর্তী রাজনৈতিক আকার কী হবে, সেটা নির্ধারণে ওয়াশিংটনের আসলে তেমন কোনো স্বার্থ নেই।’

আরো বড় আঞ্চলিক অস্থিরতা এবং শরণার্থী সংকটের শঙ্কা ঘিরে রেখেছে রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক- তিন দেশকেই। আসাদের পতনে তুরস্ক এইচটিএস প্রধান আবু মোহাম্মদ আল-জোলানিকে সহযোগিতা করলেও সংগঠনটি তুরস্কে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত। তাই যত বেশি অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেবে এইচটিএস, ততোই অস্ত্রবিরতিসহ নানা দাবি-দাওয়ার জন্য গোষ্ঠীটিকে চাপ দেয়া কঠিন হয়ে যাবে আঙ্কারার জন্য।

তবে শেষ পর্যন্ত প্রধান বিজয়ী হিসেবে উত্থান ঘটলো জোলানিরই। কারণ আলেপ্পো থেকে শুরু করে সিরিয়ার পুরো উত্তরাঞ্চল আর রাজধানী দামেস্কও এইচটিএসের নিয়ন্ত্রণে। জঙ্গি সংগঠন হিসেবে যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে সারা দেশের অন্যতম প্রভাবশালী গোষ্ঠী এইচটিএস। তবে দামেস্কে আসাদের ছেড়ে যাওয়া প্রেসিডেন্ট প্যালেসের উত্তরসূরি জোলানি হবেন কি না, সে প্রশ্নের উত্তর হয়ত সময়ই বলে দেবে।

এএম