বিশেষ প্রতিবেদন
দেশে এখন
0

রাজধানীতে পাবলিক টয়লেট না থাকায় পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

ঢাকার বাসযোগ্যতা কমে আসার অন্যতম কারণ পাবলিক টয়লেট বা গণশৌচাগারের তীব্র সংকট। হাতেগোনা যেসব পাবলিক টয়লেট রয়েছে তাও পরিণত হয়েছে ব্যবসা কেন্দ্রে। এতে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি রোগবালাই ডালপালা মেলে ঝুঁকিতে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, টাকা দিয়ে টয়লেট পরিচালনা বিশ্বে বিরল। তাই এই মডেলে পরিবর্তন আনার দাবি তাদের।

আন্তঃনগর বাস টার্মিনালের ভেতরে নেই স্বাগত জানানোর পরিবেশ। কেউ এখানে অপেক্ষায় থাকে না কারো জন্য। বরং ডানে বামে না দেখেই সেরে নেন জরুরি কাজ । যেন পুরো টার্মিনালটিই এক প্রক্ষালন ময়দান।

টার্মিনালে কাজ করা একজন বলেন, 'কোনো কথাতেই কাজ হচ্ছে না। সবাই সবার মতো করে রেখে যায়। আমাদের তো এখানেই খেতে হয়। এই দুর্গন্ধের মধ্যেই খেতে হয়।'

জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক সংস্থা ইউএনপিপি'র তথ্যে, মহানগরী ঢাকায় দুই কোটি ৩৯ লাখ মানুষের বাস, যেখানে দুই তৃতীয়াংশ মানুষই প্রতিদিন ঘরের বাইরে যাচ্ছেন। তবে তাদের জন্য দুই সিটি করপোরেশন মিলিয়ে পাবলিক টয়লেট আছে মাত্র ১৬৭টি। অর্থাৎ নগরীতে চলাচল করেন এমন প্রায় সোয়া লাখ মানুষের জন্য পাবলিক টয়লেট আছে একটি।

গণশৌচাগারের তীব্র সংকটে বেগ চেপে রাখার অভ্যাস গড়েছেন অনেকে। আর বাকিরা চক্ষুলজ্জা এড়িয়ে খোলা আকাশের নিচে সাড়া দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

একজন পথচারী বলেন, 'যখন আপনার কাছে পাবলিক টয়লেটের অপশন থাকবে তখন তো এভাবে কেউ রাস্তায় করবে না। অ্যাভেইলেবল না থাকার কারণে বেশিরভাগ মানুষই এভারে রাস্তায় কাজ সেরে ফেলে। এটা বিব্রতকর ও এর উদ্যোগ নেয়া জরুরি।'

পাবলিক টয়লেট সংকটে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন কর্মজীবী ও নারী শিক্ষার্থীরা। বিড়ম্বনা এড়াতে তাদের অনেকেই নিয়েছেন অপর্যাপ্ত পানি পানের কৌশল। আছেন মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।

একজন নারী বলেন, 'আমরা যখন বাইরে যাই আমরা চেষ্টা করি যতটা কম পানি ও খাবার গ্রহণ করা যায়। আমরা আশেপাশে এত এটিএম বুথ দেখি কিন্তু কোনো পাবলিক টয়লেট বা ওয়াশরুম দেখা যায় না। আবার যেগুলো আছে সেগুলোও মেয়েদের জন্য ব্যবহারের উপযোগী না।'

অন্য একজন নারী বলেন, 'অনেকসময় দেখা যায় আমাদের চেপে থাকতে হয়। এতে তো শরীরের ক্ষতি হয়। ওয়াশরুমের জন্য শপিংমল বা রেস্টুরেন্ট খুঁজতে হয়। আবার রাত হলে তো তাও পাওয়া যায় না।'

মোবাইল টয়লেটসহ ১১৪টি পাবলিক টয়লেট আছে ঢাকা উত্তর সিটিতে। যার ৭৪টি সরাসরি উত্তর সিটি করপোরেশন ও সরকারিভাবে নির্মিত ও পরিচালিত। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের হালনাগাদে ৭০টি গণশৌচাগার থাকলেও এর মধ্যে বন্ধ ও ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ায় পরিত্যক্ত অনেকগুলো।

গত এক দশকে ওয়াটার এইড, স্পেস, ভূমিজ, আরবানের মতো বিভিন্ন এনজিও বেশকিছু পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করে, যেখানে রয়েছে নারী,পুরুষ ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। আছে সিসিটিভি ক্যামেরা ও লাগেজ রাখার মতো বেশকিছু সুবিধা।

রাজধানীসহ সারাদেশে পাবলিক টয়লেট ব্যবহারে আরেকটি বাধা ব্যবহার ফি। কারণ এগুলো ব্যবহারে গুণতে হয় অন্তত পাঁচ থেকে ১০ টাকা। এছাড়া ইজারা ও বিভিন্ন সমিতির মাধ্যমে পরিচালিত অনেক পাবলিক টয়লেট পরিণত হয়েছে ব্যবসা কেন্দ্রে। কোথাও শৌচাগারের জন্য বরাদ্দ পানি বিক্রি করে দেয়া হয়, আবার কোথাওবা ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন পণ্যের স্টোররুম হিসেবে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বলছে, পাবলিক টয়লেট পরিচালনায় ইজারাদারের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত অর্থ আদায়সহ অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেলে অপসারণ করা হবে। আর লোকবল ঘাটতি পূরণ হলে সরাসরি পরিচালনাতর দায়িত্ব নেবে সিটি করপোরেশন নিজেই।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেন, 'বেশিরভাগ পাবলিক টয়লেট কিন্তু বিভিন্ন সংস্থা বা এনজিওর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তাদের সাথে আমাদের একটা চুক্তি হয়। সেখানে স্পেসিফিকেশন দেয়া থাকে। এখানে মূল্য কতটাকা দর হবে, তাদের কী কী করতে হবে সব উল্লেখ থাকে। এই শর্ত ভঙ্গ করলে যা করতে হয়, যে অ্যাকশন নেয়া দরকার তা আমরা নিবো। ড্রেনেজ সার্কেলের জনবল নিয়োগ হলে বেশিরভাগ টয়লেট আমরাই পরিচালনা করবো। তখন যে অবিযোগগুলো আছে সেগুলো আরও ভালোভাবে টেককেয়ার করা আমাদের সম্ভব হবে।'

তবে আপাতত গণশৌচাগার সংকট মাথায় নিয়ে ঢাকার জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে চলছে। বাড়ছে ইউরিন ইনফেকশন, কিডনি বিকল আর রেচনতন্ত্রের জটিল রোগ আক্রান্তের সংখ্যা

জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. মো. আবদুস শুকুর বলেন, 'চেপে ধরে রাখলে প্রস্রাবের থলিতে অনেক প্রস্রাব থাকে। সেক্ষেত্রে মাংসপেশিগুলো সবসময় প্রসারিত অবস্থায় থাকে। পরবর্তীতে তার সংকুচিত হওয়ার যে শক্তি, সে তীব্রতা স্বাভাবিক অবস্থায় আর আসে না। প্রসারিত হয়েই থাকে। সেক্ষেত্রে প্রস্রাব করার পরও দেখা যায় তাদের প্রস্রাব যথেষ্ট পরিমাণে জমা থাকে। এটা থেকে পরে পাথর, ইনফেকশন, কিডনি নষ্ট হওয়ার একটা বড় কারণ হতে পারে।'

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন টাকা নিয়ে পাবলিক টয়লেট পরিচালনা বিশ্বে বিরল। প্রচলিত এই মডেল থেকে বের হতে হবে সিটি করপোরেশনকে। জনবহুল ঢাকার প্রতি ৪০০ মিটার এলাকায় অন্তত একটি ও নগরীতে ৬০০ থেকে ৭০০ পাবলিক টয়লেট থাকা আবশ্যক বলেও মনে করেন পরিকল্পনাবিদরা।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, 'জনস্বাস্থ্যে প্রতিবিধান করা কিন্তু আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রকে দায়দায়িত্ব দিয়েছে। এবং সিটি করপোরেশনের স্থানীয় সরকার আইনেও কিন্তু জনস্বাস্থ্যের দায়দায়িত্ব করপোরেশনকে দেয়া হয়েছে। এ জন্যই প্রতিটি মানুষের জরুরি প্রয়োজনে পাবলিক টয়লেটে যাওয়াটা জরুরি অধিকার। বিশ্বে বাংলাদেশের মতো এমন নেই যে পাবলিক টয়লেট দিলেই সেটা মেইন্ট্যানেন্সের টাকা করপোরেশন নেয়। কারণ করপোরেশন তো ট্যাক্স নিচ্ছে তাহলে কেন মানুষের থেকে সেই টাকা নিতে হবে। যেই শহরে মেট্রোরেল আছে সেই শহরে পাবলিক টয়লেট নেই কেন সেটা অচল গল্প।'

নগর পরিকল্পনাবিদদের পরামর্শ নগরীর মসজিদ, রেস্টুরেন্ট,পাম্পের টয়লেটগুলো ব্যবহার বিধি তৈরি করে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করার।

এসএস