রাজধানীর কুড়িল থেকে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার কিংবা নরসিংদীর পাঁচদোনা রুটে বিআরটিসি'র বাস ছাড়া অন্য কোনো গণপরিবহন নেই। সিএনজি বা অন্যান্য যানবাহনে চলাচলের উপায় থাকলেও ভাড়ার সাথে ভোগান্তিও বেশি। যাত্রীরা অপেক্ষা করেন লাল বাসের জন্যই।
একজন যাত্রী বলেন, 'বিআরটিসিতে এসিও আছে, নন এসিও আছে। আবার শিক্ষার্থীদের জন্য এখানে বাস ভাড়াটাও কম অন্যসব যানবাহনের তুলনায়। আর বাসের মধ্যে বিআরটিসি ছাড়া অন্য কোনো বাস নেই এই রাস্তায়।'
এছাড়াও রাজধানীর ভঙ্গুর গণপরিবহন ব্যবস্থায় যাত্রীদের অন্যতম ভরসার নামও বিআরটিসি। যদিও তার সেবা এবং প্রাপ্যতা নিয়ে মানুষের অভিযোগ কম নয়।
একজন যাত্রী বলেন, 'বাসের জন্য আমাদের অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। বাসের সংখ্যা বাড়ালে ভালো হয়।'
জনগণের দুর্ভোগ কমিয়ে আধুনিক সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বর্তমানে আন্তঃজেলা, দূরপাল্লা ও আন্তর্জাতিকভাবে ২০৩ রুটে বাস চালায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি)। গণপরিবহনের রোল মডেল হিসেবে গড়ে উঠতে যার সূচনা হয় ১৯৬১ সালে। কিন্তু নানা অনিয়মে বেসরকারি পরিবহনের তুলনায় বারবার পিছিয়েই পড়ছে দৃষ্টান্ত সৃষ্টির লক্ষ্যে গঠিত এই প্রতিষ্ঠান। অল্পদিনে গাড়ি বিকল হয়ে পড়া, পর্যাপ্ত গাড়ির অভাব, লিজিং পদ্ধতি, অনুন্নত বাস ডিপো, মেরামতখানার অক্ষমতা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বেচ্ছাচারিতার মতো বিভিন্ন অভিযোগে জর্জরিত হয়ে পড়ে বিআরটিসি।
তারপরও দেশের বেহাল গণপরিবহনের জগতে জনগণের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বিআরটিসি প্রতিনিয়ত নিজেদের বহরে যুক্ত করেছে যানবাহন। ঋণের এক হাজার ২৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি প্রকল্পের মাধ্যমে দেড় হাজারের বেশি বাস কেনা হয় ২০০৯ সাল থেকে। তারপরও প্রতিবছর ক্ষতির বোঝা টানতে হচ্ছিলো বিআরটিসি'র।
বিকল হয়ে পড়ে থাকা বাস যার মূল কারণ। ২০১৭ সালে এক হাজার ৫৩৫টি বাসের বিপরীতে সড়কে ছিল ৯৮১টি। ২০১৮ সালে যা কমে দাঁড়ায় ৯৪০টিতে। গেল মে মাসে সংসদীয় কমিটিকে দেয়া বিআরটিসির তথ্যমতে, বর্তমানে এক হাজার ২৪৪টি বাস চলাচল করছে। এছাড়া মেরামতাধীন রয়েছে ১০৬টি বাস।
তবে বিআরটিসি'র বার্ষিক আয়-ব্যয়ের প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গেল তিন বছরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এই পরিবহন প্রতিষ্ঠান। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৫৮ কোটি ৮৮ লাখ আয়ের বিপরীতে পরিচালন খরচ হয়েছে ২৬৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ ৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা লোকসান গুনেছে বিআরটিসি।
যদিও পরের অর্থবছরে প্রায় কোটি টাকা আয় করে প্রতিষ্ঠানটি। ২০২০-২১ অর্থবছরে আবারও দুই কোটি ৫৭ লাখ টাকা ক্ষতি গুণে বিআরটিসি। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪৭৫ কোটি ৯০ লাখ আয়ের বিপরীতে খরচ হয় ৪৪০ কোটি ১৫ লাখ টাকা, যেখানে মুনাফা আসে ৩৫ কোটি ৭৫ লাখ। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা আয় করেছে বিআরটিসি।
বিআরটিসি চেয়ারম্যান জানান, গেল তিন বছর অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কোনো প্রণোদনা নেয়নি সরকারি এই প্রতিষ্ঠান। দায়িত্ব নেয়ার সময় ৮৮৫টি সচল গাড়ি ছিল জানিয়ে এখন এক হাজার ২০০ বেশি গাড়ি চলাচল উপযোগী করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। ট্রিপভিত্তিক গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে, কমেছে লিজ দেয়া।
বিআরটিসি'র চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম বলেন, 'আমি এসে প্রথমে বলেছি যে লিজ আর চলবে না। লিজ বাতিল, বাতিল, বাতিল। এই মুহূর্তে মনে হয় মাত্র ২৭ বা ২৮টি গাড়ি লিজে আছে। সমস্ত পুরান গাড়িকে আমি মেরামত করে সেগুলোর লাইফটাইম বৃদ্ধি করেছি। বিআরটিসির সফলতার মূল জায়গাটা হলো কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো এখন পূর্ণদমে সচল হয়েছে।'
সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসাবে নানান সুবিধা পায় বিআরটিসি। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির সেবার মান আরও বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। জানান, সক্ষমতার বাইরে গিয়ে রুট পরিচালনা না করা ও অপারেশনাল দুর্বলতা কাটিয়ে উঠলে বিআরটিসি জনগণের পরিবহন হয়ে উঠতে পারে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, 'বেসরকারি সেক্টরে যারা অপারেটর আছে, তাদের যে পরিবহনগুলো আছে, তারা কিন্তু সেগুলো ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে দেখি সড়কে চালাতে পারে। কিন্তু বিআরটিসির এতো সুবিধা থাকার পরও তাদের মেইনটেন্যান্স উইং আছে, তাদের অপারেশনস উইং আছে আলাদা করে, তাদের প্রশিক্ষিত লোকবল আছে। তারপরও আমরা দেখি যে বাসগুলো দ্রুত নষ্ট হয়ে যায় বা ভারি মেরামতের প্রয়োজন হয়। বিআরটিসিকে ভাবতে হবে শুধু রুট বাড়ানো না, যে রুটেই আমি বাস চালাই না কেন সে রুটের যাত্রীর চাহিদা অনুযায়ী আমার অপারেশনের একটা প্ল্যান থাকবে, শিডিউল থাকবে, ফ্রিকুয়েন্সি থাকবে যেন যাত্রীরা জানতে পারে যে বাস কখন আসবে আর কখন ছাড়বে। অর্থাৎ গণপরিবহনের যে চরিত্র সেটা কিন্তু আনতে হবে।'