১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকেই ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে ইসরাইলকে ধ্বংস করতে যে প্রতিরোধ অক্ষ ইরান গড়ে তুলেছে, ইসরাইলে সেটি রিং অব ফায়ার নামে পরিচিত। এই প্রতিরোধ অক্ষে রয়েছে শিয়া যোদ্ধা হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথি যোদ্ধা, ইরাক আর সিরিয়ার সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং সুন্নি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস।
সেই থেকে বছরের পর বছর ধরে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ইরান ও ইসরাইল। কখনও সশস্ত্র গোষ্ঠী ব্যবহার করে, কখনও গুপ্তচর ব্যবহার করে গোপনে চলছে দুই দেশের ছায়াযুদ্ধ। কিন্তু অক্টোবরে ইসরাইল আর ইরানের সরাসরি হামলার ঘটনা প্রমাণ করে, নীরব এই যুদ্ধ এখন চলছে প্রকাশ্যে। মধ্যপ্রাচ্য সংকট সমাধান না হলে যেই যুদ্ধ চলতেই থাকবে।
সংবাদ মাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণ বলছে, দুই চিরশত্রুর যুদ্ধ এখনও শুরু না হলেও ভবিষ্যতে ইরান-ইসরাইল বৈরিতা দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে সংঘাত। গেলো ৭ অক্টোবর ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীর ইসরাইলে হামলার পরও দুই দেশের সরাসরি সংঘাতে জড়ানোর শঙ্কা ছিলো খুব কম। অথচ এই সংঘাতই এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরাই্ল হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ, হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যার পর ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে শূন্যতা তৈরি হয়েছে। দুই সংগঠনই অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চলে গেছে একরকম নিরপেক্ষ অবস্থানে। যে কারণে ইরানকে সরাসরি মাঠে নামতে হয়েছে।
তেল আবিব ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটির বিশ্লেষক বেনি সাবতি বলেন, ‘হিজবুল্লাহ ইসরাইলের উত্তরাঞ্চলে হামলা করছে, কিন্তু কোনো সংগঠন নেতৃত্ব ছাড়া চলতে পারে না। হামাস তো একরকম ভ্যানিশ হয়ে গেছে। দুই সংগঠনই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইরানের জন্য বড় পরিবর্তন। ইরান এমন কোথাও বিনিয়োগ করবে না যেখানে লোকসান হয়। যে কারণে ইরান সরাসরি মাঠে নেমে গেছে।’
ইসরাইলের হামলার পর ইরানের প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিশ্ব পরিমণ্ডলে নানা আলোচনা হলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানের পরমাণু কার্যক্রম নিয়ে পুরো বিশ্ব জানে, ইরান বোমা বানালে সেটাও গোপন থাকবে না। অন্যদিকে, দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো না। যে কারণে সংঘাতে না জড়িয়ে সেই অর্থ দেশের কাজে লাগাতে ব্যস্ত দেশটির প্রেসিডেন্ট।
বেনি সাবতি বলেন, ‘ইরান প্রশাসন ইসরাইলে সরাসরি হামলা করার মতো অবস্থায় নেই। দেশের অর্থনীতি ভালো অবস্থায় নেই। ইসরাইলে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে ইরানের ২২০ কোটি ডলার খরচ হয়েছে। অথচ এই অর্থ গাড়ির জন্য জ্বালানি কিনতে ব্যয় করতে পারতো ইরান। অর্থ না থাকলে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে ইরান সহযোগিতা করতে পারবে না। পরমাণু হামলার ইস্যু তো আসছেই না।’
এদিকে, মধ্যপ্রাচ্যে এমন সংকটের সময় কিছুদিনের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। যুক্তরাষ্ট্র সবদিক থেকে চেষ্টা চালাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে যেন পুরোদমে আগ্রাসন শুরু না হয়ে যায়। কারণ এই অঞ্চলে আগ্রাসন শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। যা পুরো বিশ্বকে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে নিয়ে যেতে পারে।
মিডল ইস্ট স্টাডি ফোরামের আহ্বায়ক শাহরাম আকবরজাদেহ বলেন, ‘কামালা যদি নির্বাচনে জেতে, মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসনে ইসরাইলের জবাবদিহিতা আরও বাড়বে। কিন্তু ট্রাম্প জিতলে ইসরাইলের যা খুশি তাই করতে পারবে। ইরান যদি ইসরাইলের বিরুদ্ধে শক্ত কোন পদক্ষেপ নিয়ে বসে, যুক্তরাষ্ট্র বিপাকে পড়ে যাবে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি আছে। কোন সেনা ক্ষতিগ্রস্ত হলে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। যা বিপদ ডেকে আনবে পুরো বিশ্বে।’
লেবানন আর গাজায় আগ্রাসন চালানো অবস্থায় ইরানে ইসরাইলের এই হামলায় ক্ষুব্ধ তেহরান। ইরানের অভ্যন্তরে আলোচনা হচ্ছে কীভাবে এই হামলার জবাব দেয়া যায়। তবে গাজা ইস্যুতে কোন সমাধান না আসলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-ইসরাইলের মধ্যে যেকোনো সময় সরাসরি সংঘাত হতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির উপদেষ্টা হাশেমোদ্দিন আশেনা বলেন, সিংহের লেজ নিয়ে খেলা করেছে ইসরাইল, এটা ফিলিস্তিন, লেবানন, ইরাক কিংবা আফগানিস্তান নয়, এটা ইরান। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরাইলে হামলা করলে যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়তে পারে, এমন আশঙ্কায় এখনও অপেক্ষা করছে তেহরান।