পশ্চিমা দেশগুলো নানাভাবে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসলেও বিশ্বের অর্থনীতি আর রাজনীতিতে নিজস্ব একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে বিশ্বের উন্নয়নশীল ও শিল্পোন্নত দেশের জোট ব্রিকস। চলতি বছরই জোটের সদস্য সংখ্যা ৫ থেকে ১০ এ পরিণত হয়। শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলোর জোট জি সেভেনের তুলনায় জনসংখ্যায় ৫ গুণ বেশি এই জোট। আরও ৩০ টিরও বেশি দেশ অপেক্ষা করে আছে এই জোটে যুক্ত হতে। আসলে কতটুকু শক্তিশালী এই ব্রিকস? বিশ্বের আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য কমাতে ঠিক কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে এই জোট?
মার্কিন বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন আর কল্পনা নয়, বাস্তবেই মার্কিন আধিপত্যকে প্রভাবিত করতে শুরু করেছে ব্রিকস। বর্তমানে বৈশ্বিক শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যে দেশগুলো ব্রিকসের সদস্য হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে, কোন দেশই যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী, উন্নত জীবনমান আর শক্তিশালী মুদ্রার অধিকারী না হলেও বীরদর্পে এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নশীল, স্বল্পোন্নত আর অনুন্নয়নশীল দেশগুলোর মনস্তত্ত্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দেশগুলো ভাবছে, জি সেভেনের অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে মিলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বঞ্চিত করেই যাচ্ছে।
মার্কিন অর্থনীতিবিদ রিচার্ড ওলফ বলেন, ‘কল্পনায় নয়, বাস্তবেই বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে ব্রিকস। যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যও পড়তে যাচ্ছে চ্যালেঞ্জের মুখে। উন্নয়নশীল, অনুন্নত দেশগুলো যা আছে তাই নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে পশ্চিমা আধিপত্যের বিপক্ষে তারা জীবনমান উন্নয়নের স্বাধীনতা চায়, পশ্চিমারা তাদের বঞ্চিত করছে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই অনেক দেশ চাইলে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের প্রতিদ্বন্দিতা করতে পারতো। কিন্তু সব দেশই ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করেছে যুদ্ধ। গ্রেট ডিপ্রেশন থেকেও বের হয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধের কারণে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ায় ডলার হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক লেনদেন ব্যবস্থার অন্যতম অনুষঙ্গ। যে কারণে প্রতিটা দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভে রাখছে ডলার আর স্বর্ণ।
রিচার্ড ওলফ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সব প্রতিযোগী দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি হয়েছে কম। যুদ্ধ দেশের অর্থনীতিকে সহযোগিতা করেছে। আমরা গ্রেট ডিপ্রেশন থেকে বের হয়েছি। অন্যান্য দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো ছিল। সেসময় একাট জিনিসই মূল্যবান ছিল, ডলার। ডলার হয়েছিলো আন্তর্জাতিক প্রতীক।’
শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলোর জোট জি সেভেনে এখন সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে, ব্রিকসে শক্তিশালী দেশ চীন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাশিয়া কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রতিযোগী হতে পারবে না। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক প্রতিযোগী হয়ে উঠেছে চীন। আর এভাবেই হয়তো একটা সময় শেষ হবে মার্কিন অর্থনীতির আধিপত্য।
তিনি বলেন, ‘ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বে আধিপত্য ধরে রাখা কঠিন হযে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। মার্কিন সাম্রাজ্য ডুবছে। বিশেষ অবস্থান আর ধরে রাখতে পারবে না যুক্তরাষ্ট্র। নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে দেশের উত্থান পতন হয়। সামরিকভাবে বিশ্বে আমাদের আশপাশে কেউ নেই । কিন্তু এগুলো চিরস্থায়ী নয়।’
এদিকে, পশ্চিমা বিভিন্ন গণমাধ্যম বলছে, এবারের ব্রিকস সম্মেলনেই আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থার বিকল্প প্লাটফর্ম তৈরি করতে সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানাবেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বর্তমানে এই জোটের সদস্য ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা। নতুন করে যুক্ত হয়েছে মিশর, ইথিওপিয়াম ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব। রাজনীতি আর অর্থনীতির দিক দিয়ে এই জোট পশ্চিমাদের টেক্কা দিতে সক্ষম বলেও মনে করছেন অনেকে।
সংবাদ মাধ্যম রয়টার্স বলছে, ব্রিকস সদস্য দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আন্তঃব্যাংক লেনদেনের জন্য একটি প্রস্তাব রয়েছে রুশ অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে। ব্ল্যাকচেইন প্রযুক্তিতে জাতীয় মুদ্রাগুলোর জন্য ডিজিটাল টোকেন সংরক্ষিত থাকবে, যে মুদ্রাগুলো দেশের মধ্যে লেনদেন হবে, ডলারের লেনদেন প্রয়োজন পড়বে না। বাণিজ্যিক লেনদেনের ক্ষেত্রে একে সুবিধাজনক বললেও স্থানীয় ব্যাংকগুলোর আশঙ্কা, এতে করে আবারও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে পারে তারা।
বর্তমানে বিশ্বের মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধির ৩০ শতাংশ নির্ভর করে ব্রিকস সদস্য দেশগুলোর ওপর। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশই ব্রিকসে অবস্থান করছে। আর এ কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে পশ্চিমা আধিপত্য কমানোর লক্ষ্য নিয়েই ব্রিকসের উত্থান।