পেজার কী?
পেজার, বা বিপার. একেকজন চেনেন একেক নামে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে খানিকটা অপরিচিত ছোট্ট এ যন্ত্র মোবাইল ফোন আবিষ্কারের আগে, বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকে ছিল বহুল ব্যবহৃত। ক্ষুদে বার্তা বা সতর্কতা আদান-প্রদানে ব্যবহার হয় বহনযোগ্য বৈদ্যুতিক ডিভাইসটি। বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে বার্তা পাঠানো যায় বলে হ্যাকিং-ট্র্যাকিং এড়াতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির স্মার্টফোন আর ইন্টারনেটের যুগেও হারিয়ে যায়নি পেজার।
ক্ষুদে বার্তা বা সতর্কতা আদান-প্রদানে ব্যবহার হয় বহনযোগ্য বৈদ্যুতিক ডিভাইস পেজার। ছবি: এখন টিভি
তাইওয়ানে অনুসন্ধান শুরু
লেবাননের শীর্ষ নিরাপত্তা সূত্রসহ আরেকটি সূত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, মঙ্গলবারের হামলার মাস কয়েক আগেই তাইওয়ান থেকে পাঁচ হাজার পেজার আমদানি করেছিল লেবাননের সশস্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন হিজবুল্লাহ। ঘটনার আদ্যপান্ত জানতে তাইওয়ানে এরইমধ্যে গোল্ড অ্যাপোলো নামে একটি প্রতিষ্ঠানে অনুসন্ধান শুরু করেছে দেশটির পুলিশ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গোল্ড অ্যাপোলোর তৈরি পেজারের ধরন এবং পেছনের স্টিকারের সঙ্গে মিল আছে বিস্ফোরিত পেজারের। যদিও বিস্ফোরিত পেজারগুলো 'ব্যাক' নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি বলে দাবি গোল্ড অ্যাপোলোর।
গোল্ড অ্যাপোলোর তৈরি পেজারের ধরন। ছবি: এখন টিভ
তাইওয়ানের গোল্ড অ্যাপোলো প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট সু চিং-কুয়াং বলেন, 'ইউরোপে একটি সংস্থা আমাদের সব পণ্যের প্রসারে কাজ করে। তিন বছর ধরে তাদের সাথে আছি আমরা। আমাদের ব্র্যান্ডের নাম ব্যবহার করে তারাও পেজার উৎপাদন করে, অর্থের বিনিময়ে আমাদের লোগো ব্যবহার করে। চুক্তিও দেখাতে পারবো চাইলে। আমার প্রতিষ্ঠান খুব বড় না হলেও আমরা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে ৩০ বছর ধরে বাজারে টিকে আছি।'
যেভাবে পেজারে বিস্ফোরক এলো!
চলতি বছরের শুরুতে পেজারগুলো কেনে তাইওয়ান। ধারণা করা হচ্ছে, অনেক মাস ধরে চলছিল পেজারের মাধ্যমে হামলার পরিকল্পনা। উৎপাদনকাজ চলার সময়েই কোনো এক পর্যায়ে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সদস্যরা ছদ্মবেশে পেজারে বিস্ফোরক লুকিয়ে রেখেছিল, যা এতো মাসেও ধরতে পারেনি হিজবুল্লাহ।
একাধিক সূত্র বলছে, প্রতি পেজারে ছিল তিন গ্রাম করে বিস্ফোরক। পরিমাণে কম হলেও শক্তিশালী এবং সেখানেও প্রযুক্তির ব্যবহার ছিল বলেই একযোগে এ হামলা চালানো সম্ভব হয়েছে। বলা হচ্ছে, বিস্ফোরণের আগে ভুক্তভোগী ব্যবহারকারীদের সবার কাছে একটি বার্তা এসেছিল।
তিন দশক আগের পেজার হামলার পুণরাবৃত্তি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, 'এ ঘটনা নতুন নয়। নব্বইয়ের দশকে একই কায়দায় গাজার শাসকদল হামাসের প্রধান বোমা বিশেষজ্ঞকে হত্যা করেছিল মোসাদ।'
বিশেষজ্ঞ যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জোসেফ স্টেইনবার্গ বলেন, 'মনে রাখা উচিত যে তিন দশক আগে হামাসের প্রধান বোমা নকশাকারীকেও হত্যা করেছিল ইসরাইল। তার নাম ছিল ইয়াহিয়া আয়াশ। দক্ষতার কারণে তাকে 'বোমার ইঞ্জিনিয়ার' বলা হতো। তাকে হত্যা করা হয়েছিল তার সেল ফোনে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে। সেবারও যন্ত্রটির ভেতরে স্বল্প পরিমাণ বিস্ফোরক লুকিয়ে রাখা হয়েছিল এবং ফোনে তার কণ্ঠ নিশ্চিত হয়ে গাজার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমান থেকে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।'
ইসরাইলি হামলায় গত এক বছরে কমান্ডারসহ পৌণে ২শ' যোদ্ধাকে হারিয়েছে হিজবুল্লাহ। তাই চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নিজেদের গোয়েন্দা অবকাঠামোর ত্রুটি শনাক্তে একটি যুদ্ধকালীন পরিকল্পনা দাঁড় করিয়েছিল গোষ্ঠীটি। সেসময়েই ইসরাইলি গোয়েন্দাদের চেয়ে ব্যবহৃত ফোন বেশি বিপজ্জনক বলে সতর্ক করেছিলেন সংগঠনের প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ। নির্দেশ দিয়েছিলেন ফোন ভেঙে ফেলার। তখনই ফোনের বদলে পেজার বিকল্প হয়ে ওঠে হিজবুল্লাহ সদস্যদের জন্য। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এতো সতর্কতা সত্ত্বেও হিজবুল্লাহ'র ওপর এ হামলা আরও বড় কিছুর আভাস।
আটলান্টিক কাউন্সিলের সিনিয়র ফেলো রিচ আউটজেন বলেন, 'ব্যবস্থাপক, পরিকল্পনাকারী, যোদ্ধাসহ হিজবুল্লাহ'র আহত ২৭শ' সদস্য হয় আঙুল হারিয়েছে, না হয় দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে, না হয় হাঁটার শক্তি হারিয়েছে। এটা হতে পারে খুব শিগগিরই ঘটতে যাওয়া আরও বড় কোনো ঘটনার আভাস। প্রকৃতপক্ষে বড় ধরনের কোনো অভিযান চালানোর আগে এ ধরনের ঘটনা ঘটায় ইসরাইল।'
এদিকে পেজার হামলার পর লেবাননের রাজধানী বৈরুতে সাময়িক বিচ্ছিন্ন রয়েছে ইন্টারনেট সংযোগ। হিজবুল্লাহ'র দাঁত ভাঙা জবাবের হুঁশিয়ারির পরও আপাতত স্বরাষ্ট্র নির্দেশনায় কোনো পরিবর্তন আসছে না বলে জানিয়েছে ইসরাইল।