বন্দর নগরী, বাণিজ্যিক রাজধানী নানা পরিচয়ে পরিচয় চট্টগ্রামের। কর্ণফুলী নদীর মোহনায় গড়ে উঠা চট্টগ্রাম বন্দরকে বলা হয় দেশের অর্থনীতির স্বর্ণদ্বার। বে টার্মিনাল, কর্ণফুলী টানেল, বৃহৎ কয়েকটি ইকোনোমিক জোন , প্রস্তাবিত ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে ও হাইওয়ে মিলে চট্টগ্রামকে বলা হচ্ছে আগামী দিনে এ অঞ্চলের ব্যবসা বাণিজ্যের হাব। এরপরেও কেনো চট্টগ্রামে বিনিয়োগে উৎসাহ হারাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কেন এ অঞ্চল ছেড়ে শিল্প স্থাপন পাড়ি জমাচ্ছেন রাজধানীসহ আশেপাশের জেলায়?
দেশের মোট রাজস্ব আয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ যোগান দেয় চট্টগ্রাম। জিডিপিতে এই অঞ্চলের অবদান ১২ শতাংশ। বন্দর সুবিধার কারণে চট্টগ্রামে গড়ে উঠেছে সরকারি তেল শোধনাগার, ড্রাইডক, ইস্পাত, সিমেন্ট, পেট্রোলিয়াম, জাহাজ নির্মাণ, শিপ রিসাইক্লিং, তৈরি পোশাকসহ ছোট বড় সাত হাজার শিল্প কারখানা। এক দশক আগেও চট্টগ্রামে শিল্পকারখানা স্থাপনে বিনিয়োগকারীদের ছিলো ব্যাপক আগ্রহ, এখন যেন ভাটার টান।
কেনো বিনিয়োগকারীরা চট্টগ্রামে বিনিয়োগে উৎসাহ হারাচ্ছেন? শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, চট্টগ্রামে বিনিয়োগের শুরুতেই হোঁচট খান উদ্যোক্তারা। বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর রাজধানী ঢাকায় হওয়ায় যে কোন শিল্প স্থাপনে দরকারি সব ছাড়পত্র বা অনুমোদনের জন্য ছুটতে হচ্ছে রাজধানীতে। অনলাইনে আবেদনের সুযোগ থাকলেও নিরূপায় হয়ে যেতে হচ্ছে ঢাকায়। ফলে ইউনিলিভার ও রেকিট বেনকিজারের মতো বহুজাতিক কোম্পানির সদর দপ্তর এক সময় চট্টগ্রামে থাকলেও তা সরিয়ে ঢাকায় নেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামে বছরে কি পরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে, বিনিয়োগ বাড়ছে কি কমছে সে তথ্য জানা নেই চট্টগ্রাম বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের স্থানীয় অফিসে। এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার পরিচালকের দপ্তরে গেলে পূর্ণাঙ্গ তথ্য সদর দপ্তরে বলে অপারগতা জানান পরিচালক। যে দপ্তরে, এ অঞ্চলে বিনিয়োগের তথ্যই থাকেনা, সেখান থেকে বিনিয়োগকারীরা কতটুকু সেবা পান সেটি সহজেই অনুমেয়।
বড় প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য ঋণ না পাওয়া, নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা না থাকায় , চট্টগ্রামের শিল্প মালিকদের ঢাকায় দ্বিতীয় অফিস রাখতে হচ্ছে, যা বাড়তি খরচ। এছাড়া সারাদেশের সড়ক ঢাকামুখী, চট্টগ্রামের সাথে কাঙ্খিত নৌ পরিবহনও গড়ে উঠেনি এতোদিনে। সব মিলিয়ে রাজধানীতে ছুটছেন শিল্পপতিরা।
বাংলাদেশ এগ্র্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের সহ সভাপতি মো. শোয়াইব হাছান বলেন, 'আপনার একটা লোন প্রসেস করতে হবে সেটা ঢাকার কেউ সরাসরি হেড অফিসে যাচ্ছে। কিন্তু চট্টগ্রামে কেউ লোন অ্যাপ্লাই করলে সেটা প্রথমে জোনাল অফিসে যাচ্ছে এরপর হেড অফিস। সরাসরি কোনো অ্যাক্সেস নেই।'
এসব সংকটের সাথে যুক্ত হয়েছে কারখানা স্থাপনে প্লটের অভাব। জমির দাম এখন আকাশচুম্বী। তাই বিনিয়োগ গুটিয়ে আশপাশের জেলা বা ঢাকায় যাচ্ছেন অনেকে। ২০২০ সালে চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে ৩০ হাজার একর জায়গা জুড়ে দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী করার উদ্যোগ নেয় সরকার। যদিও সেখানে এখনো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে উঠেনি। পানির সংকট প্রকট হওয়ায় এই শিল্প নগরীর ভবিষ্যত নিয়ে শংকিত উদ্যোক্তারা।
বিজিএমইএ'র সাবেক প্রথম সহ সভাপতি মো. নাসিরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, 'গার্মেন্টস সেক্টরে এখানে কেউ বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে না। এখানে কর্মীর সংকট আছে। বায়াররাও তেমন আসতে চায় না।'
একসময় পোশাক খাতে মোট আয়ের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ যোগান দিতো চট্টগ্রাম। সুযোগ সুবিধার অভাবে বিদেশি বিনিয়োগকারী ও ক্রেতারাও কম আসেন চট্টগ্রামে। তাদের সাথে সাক্ষাতেও যেতে হচ্ছে রাজধানীতে।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক অঞ্জন শেখর দাশ বলেন, 'গার্মেন্টস সেক্টরে বন্দর থাকা স্বত্তেও এখানে বিনিয়োগ হচ্ছে না কারণ বায়িং হাউস বা বায়াররা ঢাকাতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করে।'
শিল্প-কারখানা স্থাপনে অপরিহার্য গ্যাস ও বিদ্যুৎ। ইপিজেড বা সরকারি শিল্পাঞ্চলের বাইরে কোন শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হচ্ছে না। পুরানো শিল্প কারখানা ইউনিট সম্প্রসারণের জন্য সংযোগ পেলেও ভারী শিল্পের জন্য সংযোগ পেতে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে দীর্ঘ দিন। গ্যাসের প্রেসার না থাকায়, ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে ব্যাহত হচ্ছে শিল্প-কারখানায় উৎপাদন।
মোস্তফা হাকিম গ্রুপের পরিচালক মো. সারোয়ার আলম বলেন, 'নতুনভাবে কারখানা স্থাপনে আমরা কিন্তু গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ পাচ্ছি না। যার ফলে আমাদের বিকল্প চিন্তাভাবনা করতে হচ্ছে।'
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, চট্টগ্রামে বিনিয়োগ ধরে রাখতে এক জায়গায় বিনিয়োগকারীদের সব সেবা দিতে হবে।
বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের হিসাবে ২০২৩ সালে দেশে ৯ বিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালে ১২ বিলিয়ন, ২০২১ সালে ১৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছিলো। অর্থাৎ গত ৩ বছর টানা বিনিয়োগ প্রস্তাব কমেছে সারাদেশে।