আমদানি-রপ্তানি
অর্থনীতি

চায়ের মান না বাড়ায় বৈশ্বিক বাজারে প্রসার বাড়ছে না

দেশের অর্থনীতির আদি উৎসগুলোর একটি চা শিল্প। স্বাধীনতার ৫০ বছরে চা বাগানের সংখ্যা ও উৎপাদন বেড়েছে। বৈশ্বিক চা উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। তবে বাড়েনি চায়ের গুণগত মান। ফলে আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে না পারায় সংশ্লিষ্টরা একে অপরকে দুষছেন। আর বিপণনে আশানুরূপ ফল না আসার কারণ হিসেবে বেশকিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ সুরমা উপত্যকায় আছে সারি সারি চা বাগান। সবুজ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনের মাঝে প্রকৃতির চা বাগান বিভাগের ৩ জেলা সিলেট, মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জের আসল রূপ।

ঐতিহ্যগতভাবেই সিলেট একটি চা উৎপাদনকারী অঞ্চল। মূলত এখান থেকেই বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চা চাষের শুরু। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৭৬ শতাংশ মানুষের পানীয় পণ্যের চাহিদা মেটাচ্ছে এই চা। আর বৈশ্বিকভাবে চায়ের মোট চাহিদার যোগান দিচ্ছে ৩ শতাংশ। বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশে যেমন চায়ের বাগানের সংখ্যা বেড়েছে তেমনি উৎপাদনও বেড়েছে কয়েকগুণ। এত সম্ভাবনা থাকার পরেও স্বস্তিতে নেই এই শিল্পটি।

পারিবারিকভাবেই চায়ের সাথে বেড়ে ওঠা আফজাল রশিদ চৌধুরীর। বাপ-দাদার পর বর্তমানে তিনিই সিলেটের শতবর্ষী তিনটি বাগানের প্রধান পরিচালক। বর্তমানে চায়ের হালচাল নিয়ে আলাপকালে বলছিলেন, অতীতের সুদিন সবুজ সোনার খাতা থেকে হারিয়েছে বহু আগেই। এখন কেবল বাপ-দাদার ব্যবসা ধরে রাখতেই হাল ধরে রাখছেন তিনি।

সিলেটের নিনা আফজাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের প্রধান পরিচালক আফজাল রশিদ চৌধুরী বলেন, 'চায়ের উৎপাদন অনেকটা বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু চায়ের প্রকৃত মূল্য কেউ পাচ্ছে না। ম্যানুফ্যাকচারিং কষ্ট প্রায় ২২৫ টাকা। কিন্তু এভারেজে চা বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা।'

সিলেটের চা বাগান। ছবি: এখন টিভি

প্রায় শত বছর থেকে চা উৎপাদনকারী এই ব্যবসায়ী বলছিলেন – শিল্পটি কৃষি থেকে বাণিজ্যিক রূপান্তরই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে এই খাতে।

বাংলাদেশের ১৬৮টি বাণিজ্যিক চা বাগানের মধ্যে ১৩৭টির বেশি চা বাগান বৃহত্তর সিলেটে। এসব চা বাগান থেকে দেশের মোট উৎপাদনের ৮১ শতাংশই হয় এ অঞ্চলে। কিন্তু ধীরে ধীরে বিনিয়োগের অভাব আর বাজার অস্থিরতায় তীব্র আর্থিক সংকটের সম্মুখীন দেশের চা শিল্প। শেষ বছরে রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদন হলেও চাহিদার তুলনায় যা নাম মাত্র বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

সিলেট শাবিপ্রবির ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং ও টি টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. ইফতেখার আহমদ বলেন, 'যেহেতু সরকার ভালোভাবে তাদের সাহায্য করছে না, বা তারা এটাকে বেশি লাভজনক মনে করছে না। এর কারণে চাষের ক্ষেত্রে তারা আগ্রহটা হারিয়ে ফেলছে। তারা অন্য ব্যবসার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে।'

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চা প্রযুক্তি উন্নয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, 'এই খাতে সরকারের অর্থ দিতে হবে। সরকার যদি এখানে অর্থ দেয় তাহলে রিটার্ন বেশি পাবে। সেক্ষেত্রে আমাদের কোয়ালিটি প্রোডাক্টটা দিতে হবে। আমাদের বিজ্ঞানীর সংখ্যা বাড়াতে হবে ও রিসার্চের জন্য ভালো এনভায়রনমেন্ট দিতে হবে।'

এই কয়েক বছরে উৎপাদন বেড়েছে ২৩ দশমিক ৬৯ গুণ আর ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের ব্যবহার বেড়েছে ১৩২ দশমিক ৫৬ গুণ। তবে চায়ের সংকুচিত বাজারকে প্রসারিত করতে হলে গবেষণার কোনো বিকল্প নেই।

দু'টি পাতা একটি কুঁড়ির অঞ্চলে সিলেটের চায়ের যখন এই অবস্থা তখন বাংলাদেশের চা শিল্পের ইতিহাসে নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছিল সমতলের চা। সেই সমতলের চা এখন কোন অবস্থায় আছে?

সমতল অঞ্চলের চা বাগান। ছবি: এখন টিভি

২০০০ সালে পঞ্চগড়ে চায়ের চাষাবাদের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সমতলে চায়ের আবাদ। এরপর ২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁও এবং লালমনিরহাট, ২০১৪ সালে নীলফামারী এবং দিনাজপুর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে এই চায়ের চাষাবাদ। চা বোর্ডের জরিপ বলছে সমতলে চায়ের চাষযোগ্য জমির পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার একরের বেশি। তবে এই জনপদে চায়ের নিম্নমানের অজুহাত দিয়ে চায়ের মূল্য কম দেয়ার অভিযোগে বাড়ছে চায়ের আবাদ। যার ফলে দুই দশক ধরে এই জনপদে চাষাবাদে এই শখের চা এখন কৃষকের জন্য শোকের মাতম হিসেবে দেখা দিয়েছে। আর চা উৎপাদনকারী কারখানাগুলোতে চলছে চা পাতার খরা।

দুই যুগ ধরে চায়ের সঙ্গে যাদের নিবিড় সখ্যতা তারা নিজের হাতেই চা গাছে করছেন নির্মম আঘাত। উপর্যুপরি কোপে কেটে ফেলা হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী চা গাছ। এমন দৃশ্য এখন পঞ্চগড়ের নিত্যদিনের ঘটনা। হতাশা, লোকসান আর ন্যায্য দর না পাবার আক্ষেপে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি চা চাষিরা।

একজন চা চাষী বলেন, 'আমরা যারা ছোটখাট চাষি, আমরা কেউই বাগান রাখবো না। এতকিছু খরচ করে আমাদের আর কুলাচ্ছে না।'

কিন্তু কৃষকদের চা বাগানের ঠিক উল্টো চিত্র বাণিজ্যিক বাগানের। সেখানে নিবিড় পরিচর্যায় শোভা পাচ্ছে সবুজ চা পাতার হাসি। রোদের ঝিলিকে চিকচিক করা একটি কুড়ি ও দুটি পাতা দুলছে সম্ভাবনার বাতাসে। রংপুর বিভাগের পাঁচটি জেলায় ২৫ একরের বেশি আয়তনে নিবন্ধিত চা বাগান আছে ৯টি আর অনিবন্ধিত এমন বড় আয়তনের চা বাগানের সংখ্যা ২১।

তবে সমতলে ২৫ একরের নিচে ক্ষুদ্রায়তন চা-বাগানের সংখ্যাও কম নয়। বিভাগে ২৫ একরের নিচে এমন ক্ষুদ্রায়তন চা বাগানের সংখ্যা ৮ হাজার ৩৩৫টি। যেগুলোর বেশিরভাগই কৃষক পর্যায়ে।

চা প্রক্রিয়াজাতকরণ মেশিন। ছবি: এখঝন টিভি

এদিকে চা মৌসুমে পালাক্রমে ছয়বার চা পাতা সংগ্রহ করার রেওয়াজ থাকলেও গেলো কয়েক বছরে পাতা সংগ্রহ কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। বাগান থেকে চা পাতা তুলে কারখানায় তৈরি হয় রেডি টি। এই প্রক্রিয়ায় চা উৎপাদন করতে সমতলে কারখানার লাইসেন্স নিয়েছে ৪৮টি প্রতিষ্ঠান। চাষীদের কাছ থেকে সবুজ চা-পাতা কিনে চা তৈরি করা এসব কারখানার ২৮টি কেবল পঞ্চগড়েই আছে। সমতলে উৎপাদিত চা নিলামে বিক্রি করেন কারখানা মালিকরা। কিন্তু কারখানা সংশ্লিষ্টরাও দিচ্ছেন লোকসানের আভাস।

গ্রিন কেয়ার অ্যাগ্রো লিমিটেডের ব্যবস্থাপক মো. মনজুর আলম বলেন, 'চাষীরা বলেছেন যে তারা আসলে চা পাতা উৎপাদন করে লোকসানের পর্যায়ে আছে। এতে আমরাও কোণঠাসা হয়ে পড়েছি, আমরাও এখন লোকসানের মধ্যে আছি।'

গত বছর সমতলের ২৮ টি চা প্রক্রিয়াজাত কারখানায় চা উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৭৯ লাখ ৪৭ হাজার ২৩০ কেজি। আর ২০২২ সালে পাঁচ জেলায় ৯ কোটি ২ লাখ ৭৪ হাজার ৬৩২ কেজি সবুজ চা পাতা উৎপাদিত হয়েছে। জাতীয় উৎপাদনে অবদান ১৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ। অঞ্চলভিত্তিক চা উৎপাদনে সিলেটের পর এখন রংপুর অঞ্চলেই বেশি চা উৎপন্ন হয়। কিন্তু দাম আর কারখানার কৌশলগত বেড়াজালে ধূসর হচ্ছে কৃষকদের চা চাষের স্বপ্ন। উত্তরে আশার আলো জ্বালানো সমতলের চায়ের যখন এমন অবস্থা তখন চায়ের বিপণনের কি অবস্থা?

দেশের ২০২৩ সালে উৎপাদন হয়েছে রেকর্ড পরিমাণ ১০ কোটি ২৯ লাখ কেজি। যা আগের বছরে তুলনায় ৯১ লাখ কেজি বেশি। কিন্তু বাড়তি উৎপাদনই এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে চা শিল্পে। চাহিদার তুলনায় বাড়তি উৎপাদন, খরচ বৃদ্ধি, নিলামে উল্টো দর কমে যাওয়া এবং এ বছর প্রায় ৬০ লাখ কেজি চা পাতা অবিক্রিত থেকে যাওয়ায় বড় ধাক্কা খেয়েছে এ শিল্প।

শ্রমিক মজুরি, রেশন, ডিজেল ও কয়লার দাম বাড়ায় গত ১০ বছরে চা উৎপাদনে খরচ বেড়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ, অর্থাৎ গড়ে বছরে ৭ শতাংশ হারে। অথচ নিলামে উল্টো দাম কমেছে । ২০২১ সালে নিলামে দর ছিল ১৯০ টাকা কেজি, ২০২২ সালে ১৯৬ টাকা, আর ২০২৩ সালে নিলামে গড় মূল্য ছিল মাত্র ১৭১ টাকা। যেখানে প্রতি কেজি চা পাতা উৎপাদনে খরচ হয়েছে ২১৭ টাকা। এ বছর প্রায় ৪৬৫ কোটি টাকা লোকসান গুনেছেন বাগান মালিকরা। বলা যায়, রেকর্ড উৎপাদন করেও সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে চা খাত।

বাংলাদেশ চা সংসদের চট্টগ্রাম ব্রাঞ্চের চেয়ারম্যান আবুল বশর বলেন, 'প্রতিবছর যে প্রোডাকশন বাড়াচ্ছে এতো উৎপাদন করে কী হবে? তখন তো আমরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলবো, মালিকরাও আস্তে আস্তে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবো। চা ইন্ডাস্ট্রি আস্তে আস্তে খারাপের দিকে চলে যাবে।'

গাছ থেকে চা পাতা সংগ্রহ করে এক জায়গায় নিয়ে আসছেন শ্রমিকরা। ছবি: এখন টিভি

চা বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, পাশের আসাম প্রদেশে হেক্টর প্রতি চা পাতা উৎপাদন প্রায় ৩ হাজার কেজি। অথচ বাংলাদেশে মাত্র ১ হাজার ৬৫০ কেজি। যে কারণে কেজিপ্রতি উৎপাদন খরচ বেশি পড়ছে। বাগান মালিকদের এ ব্যর্থতার দায়, ভোক্তাদের ঘাড়ে চাপাতে চান না প্যাকেটিয়ার্সরা।

ড্যানিশ টি স্টেটের জি এম খাদেম মো. সায়েম বলেন, 'ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দেয়াটা আমার মনে হয় না ইথিক্যাল হবে। আগে স্কিল ডেভেলপ করতে হবে। ন্যাশলাম এভারেজ বাড়লে প্রোডাক্টিভিটি যখন বাড়বে প্রোডাকশন খরচ তখন এমনিতেই কমে আসবে।'

ভোক্তারা কী আসলেই কম দামে চা পাতা পাচ্ছে বাজারে? খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চা পাতা বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়, যা নিলাম মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ। নিলামে মূল্য কমলেও, খুচরা বাজারে ঠিকই বেড়েছে চা পাতার দাম।

উদ্যোক্তারা বলছেন, রপ্তানি না বাড়লে এ মুহূর্তে চা খাতে লোকসানের ভার আরও বাড়বে। রুগ্ণ হবে সম্ভাবনাময়ী এ শিল্প।

এমএসআরএস

এই সম্পর্কিত অন্যান্য খবর