রাজশাহীর গ্রাম অথবা শহরের শৈশব স্মৃতি থেকে কাজলাদিদির বাঁশ বাগানের গল্প যেন হারাতে বসেছে। বাঁশের ঝাড় আর শুকনো পাতার মড়মড় শব্দের সাথে কমছে গৃহস্থালী কাজে বাঁশের ব্যবহার। তবে আধুনিক কৃষিকাজে এর ব্যবহার বেড়েছে। রাজশাহীর পবা, মোহনপুর, দুর্গাপুর এবং পানের বরজ অধ্যুষিত পুঠিয়ায় এখন কদর এই বাশেঁর।
পানের বরজ চাষি বলেন, 'পানের চাষের ক্ষেত্রে আমাদের বাঁশের চাহিদা বেশি। এই কারণে আমাদের বাঁশ বেশি কাটা পড়ে।'
চার উপজেলায় প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টরে ৩৫ হাজারের বেশি পান বরজে চাষ হয় দশধরনের পান। চৈত্র-বৈশাখ আর জৈষ্ঠ্যে ঝড় ও শীলা বৃষ্টির হাত থেকে কোটি টাকার ফসল রক্ষায় ব্যবহার হয় বাঁশের। এছাড়া বরজ মেরামত, নতুন বরজ তৈরি বা গ্রীষ্মকালীন সবজির খেতে মাচা তৈরির কাজেও ব্যবহৃত হয় এ প্রাকৃতিক খুটির।
পানের বরজ চাষিরা বলেন, 'ঝড়ের মৌসুম আসতেছে তাই আগাম প্রস্ততি নিচ্ছি যেন বরজের ক্ষতি না হয়।'
আরেকজন বলেন, 'এখন ঠিক করলে সামনের বছর আবার ঠিক করতে হবে এই কারণে বাঁশ বেশি লাগে। জায়গা আনুযায়ী খুটি কিনতে হয়। যেমন আমার খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকার মতো।'
স্থানীয়ভাবে উৎপাদন কম হওয়ায় উত্তরের জেলা দিনাজপুর, পঞ্চগড় ও লালমনিরহাট থেকে বাঁশ আনা হয় রাজশাহীতে। প্রতি ট্রাকে আনা হয় প্রায় পৌনে দুই লাখ টাকার বাঁশ। মৌসুমে স্থানীয় চাহিদা মেটাতে একেক আড়তে প্রয়োজন পড়ে ৩০ থেকে ৪০ ট্রাক। তাতে ব্যবসা হয় অন্তত ৪৫ কোটি টাকার।
বাঁশ ব্যবসায়ী বলেন, 'আমার আড়তে প্রতিমাসে ৬০ লাখ টাকার বেচাকেনা হয়। এইরকম তিনটা থানা মিলে ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়।'
এসব আড়তের বাঁশের ওপর ভিত্তি করে স্থানীয়রা তৈরি করেন চাষবাসে ব্যবহৃত নানা উপকরণ। বাঁশ কেটে খুটি বা লগড়, ফালি করে কাটা বাঁশকে বাতা বা উপসি নামে বিক্রি করা হয়। যেখানে ৮০টি বাতায় এক পুন এবং ১৬ পুনে এক কাউন এককে বিক্রি হয় পানের বরজ তৈরির উপকরণ। যা মৌসুমে প্রতি কাউনের দাম পড়ে চার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। এসব উপকরণ বিক্রির হাট বসে সপ্তাহে দুইদিন। প্রতিহাটে বেচাকেনা হয় অন্তত ৩২ লাখ টাকার পানবরজ ও কৃষিকাজের এই অনুষঙ্গটি। সপ্তাহে দু'দিন জেলার একদ্বিলতলা, মৌগাছী, মচমইল, দূর্গাপুরসহ ৮টি হাটে বাঁশের বেচাকেনান হয় অন্তত আড়াই'শ কোটি টাকার।
ক্রেতারা বলেন, 'বাতা কিনতে আসছি দাম অনেক বেশি। কেউ ৫ হাজার আবার কেউ ৭ হাজারও চাচ্ছে।'
বিক্রেতারা বলেন, 'প্রতি পুন বাতা বিক্রি হচ্ছে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকায়। ভরা মৌসুম তাই দাম বেশি।'
হাটের বাইরেও বাঁশ কারখানায় কর্মসংস্থানের সুযোগ হয় গ্রামের তরুণদের।
তরুণরা বলেন, 'এই হাট থাকার কারণে আমাদের উপকার হয়। লেখাপড়ার পাশাপাশি কাজ করে আমরা প্রাইভেট খরচ চালায়।'
আরেকজন বলেন, 'এইটা আমাদের চুক্তির কাজ। আমাদের প্রত্যেকদিন ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা পারিশ্রমিক দিয়ে থাকে।'
দুই দশক আগেও রাজশাহীতে বাঁশের ঝাড় বেশি থাকলেও এখন আছে ১৭৫ হেক্টর জমিতে। কৃষি বিভাগ বলছে উচ্চমূল্যের একাধিক ফসল উৎপাদনের কারণে বাঁশের বাণিজ্যিক উৎপাদনে আগ্রহ নেই কৃষকের। তাতেই স্থানীয়ভাবে উৎপাদন কমেছে।
রাজশাহীর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা উম্মে ছালমা বলেন, 'বিভিন্ন ধরনের ফসল এখানে আবাদ হয়। দীর্ঘমেয়াদি বাঁশ বাগান করে জমি রেখে দেওয়ার আগ্রহ নেই এখানে। উচ্চমূল্যের ফসল আমাদের এখানে আবাদ হয়।'
রাজশাহীতে উৎপাদিত বাঁশের উচ্চতা বেশি হওয়ায় প্রতি পিস ২৫০ টাকায় বিক্রি হয় যা বাইরের জেলা থেকে বেশি।
বনজ সম্পদ বাঁশ রাজশাহী অঞ্চল থেকে কমছে ধীরে ধীরে। তবে এর ব্যবহার একই ভাবে বাড়ছে এই অঞ্চলের প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার উৎপাদিত পানের ক্ষেত্রে। তাতে এই অঞ্চলের বাঁশ প্রক্রিয়াকরণ কারখানাগুলো থেকে প্রতি মাসে বিক্রি হচ্ছে আরও অন্তত আট লাখ টাকার বাঁশ।