আমদানি-রপ্তানি
অর্থনীতি
0

নির্বাচনের আগে ভারতের 'পেঁয়াজ রাজনীতি'

চলতি বছর কমেছে প্রতিবেশি ভারতে ফল ও সবজিসহ প্রায় সব ধরনের রবি শস্যের উৎপাদন। বিশেষ করে ফলন কমেছে আলু ও পেঁয়াজের। অস্থির কৃষিপণ্য হিসেবে পরিচিত পেঁয়াজের উৎপাদন কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। এমন পরিস্থিতিতে ভারতীয় পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ অনির্দিষ্টকালের জন্য বাড়িয়ে দেবার নেপথ্যে কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে, দেশটির ১৮তম সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ বাজার স্থিতিশীল রাখার চেষ্টাকে।

রান্নার পেঁয়াজ নিয়ে ভারতের রাজনীতিতে হুলস্থুল নতুন নয়। পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে সরকার বদলে যাওয়ারও ইতিহাস রয়েছে দেশটিতে। ১৯৮০ সালের সপ্তম সাধারণ নির্বাচনকে প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী আখ্যায়িত করেছিলেন 'পেঁয়াজের নির্বাচন' বলে। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে ১৯৭৭ সালে প্রথম পরাজয় দেখা কংগ্রেস তার হাত ধরেই ক্ষমতায় ফিরেছিল ১৯৮০ সালে। ১৯৯৮ সালে দিল্লির নির্বাচনে বিজেপি'র পরাজয়ের পেছনেও বড় কারণ হিসেবে উঠে এসেছিল পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির শঙ্কায় তাই ১৬তম সাধারণ নির্বাচনের একবছর বাকি থাকতেই খাদ্যপণ্যের বাজার স্বাভাবিক রাখতে মরিয়া নরেন্দ্র মোদির সরকার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতে সবজি ও ফলের মোট ফলন আগের বছরের তুলনায় খানিকটা কমবে বলে উঠে আসে কৃষি মন্ত্রণালয়ের চলতি মাসের এক প্রতিবেদনে।

প্রধান সব কৃষিপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে অস্থির পেঁয়াজের ফলন কমেছে ১৬ শতাংশ। গেলো বছর বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার পর মহারাষ্ট্রে বৃষ্টিতে নষ্ট হয় বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ। এর প্রভাবে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ৩০ রুপি থেকে বেড়ে সেপ্টেম্বরে বিক্রি হচ্ছিল ৬০ রুপি দরে।

এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারে রপ্তানি কমিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে গেলো বছর আগস্ট থেকে পেঁয়াজের ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য বৃদ্ধি, রপ্তানি শুল্ক আরোপ, এমনকি পেঁয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধের মতো ব্যবস্থা নেয় ভারত সরকার। নিষেধাজ্ঞা আসছে ৩১ মার্চ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এর আগেই এলো রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ অনির্দিষ্টকালের জন্য বৃদ্ধির ঘোষণা।

১৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে নাজেহাল সাধারণ ভারতীয়দের মধ্যে নির্বাচনের আগে স্বস্তি ফেরানোর লক্ষ্যে নেয়া এসব পদক্ষেপে এবং বাজারে নতুন পেঁয়াজ তোলার সময় এগিয়ে আসায় অভ্যন্তরীণ বাজারে পেঁয়াজের দাম অর্ধেকের বেশি কমে গেছে বলে জানান ভারতের পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা। পেঁয়াজ উৎপাদনে ভারতের শীর্ষ রাজ্য মহারাষ্ট্রে ১০০ কেজি পেঁয়াজের পাইকারি মূল্য সাড়ে চার হাজার রুপি থেকে ডিসেম্বরে নেমে যায় ১২০০ রুপিতে। তাই মেয়াদ শেষে নিষেধাজ্ঞা শিথিলের প্রত্যাশা বাড়ছিল।

কিন্তু তিন মাসে পরিস্থিতি আবারও কিছুটা বদলেছে। ভারতের ভোক্তা বিভাগের তথ্য, শুক্রবার প্রতি কুইন্টাল পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছিল আড়াই হাজার রুপিতে, যা একবছর আগের তুলনায় একহাজার রুপি বেশি। এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ আসে পেঁয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধের সময় বাড়ানোর ঘোষণা, যা বেশি অপ্রত্যাশিত ছিল রপ্তানিকারকদের জন্য। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বলা হয়, নির্বাচনের একমাস বাকি থাকতে এ সিদ্ধান্তের সম্ভাব্য কারণ বিজেপি সরকারের ভোট ব্যাংক বড় করা।

স্থানীয় প্রশাসনের তথ্য, ভারতে রবি শস্যের ৬০ শতাংশই পেঁয়াজ। চলতি মৌসুমে সামগ্রিকভাবে রবি শস্যের ফলন কমে যাওয়ায় এখনই অন্যতম প্রধান কৃষিপণ্য পেঁয়াজের রপ্তানি শুরু করতে চায় না ভারত। গেলো মাসেই ভারতের খুচরা বাজারে পেঁয়াজের মূল্যস্ফীতি ছিল ২২ শতাংশের বেশি, তার আগে জানুয়ারিতে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছিল একবছর আগের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি দামে।

পেঁয়াজ রপ্তানিতে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ ভারত। ২০২২ সালে বিশ্ববাজারে ৫২ কোটি ৪৬ লাখ টন পেঁয়াজ রপ্তানি করে নেদারল্যান্ডস ও চীনের পর তালিকার তৃতীয় অবস্থানে ছিল ভারত। সে বছর দেশটির মোট রপ্তানি পণ্যের প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশই ছিল পেঁয়াজ। ভারতীয় পেঁয়াজের বড় অংশই যায় বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে।