দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৪০ শতাংশ আসে নারায়ণগঞ্জ থেকে। গত দুই থেকে তিনমাসে এখানকার উৎপাদন ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। শুধু নারায়ণগঞ্জের বিসিক এলাকা নয়, শিল্পনগরীর প্রায় প্রতিটি কারখানার অবস্থা একই চিত্র।
অনেক কারখানা কাপড় ডায়িং এর জন্য নির্ভর করছে নরসিংদির ফ্যাক্ট্রিগুলোতে। এতে সময় ও খরচ দুটোই বেড়েছে। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ক্রয়াদেশ পুরণও।
বিকেএমইএ'র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘এখন ২৪ ঘণ্টা গ্যাস থাকে না। আমার এখানে গত একমাসে ডাইং হয়েছে মাত্র ৮০ টনের মতো। যেখানে প্রতিদিন ১১০ টন হতো। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আমাদের পক্ষে রপ্তানি ধরে রাখা খুব কঠিন হবে। বিশেষ করে, জরুরি খাত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং এই সমস্যা সবচেয়ে বেশি তীব্র নারায়ণগঞ্জ এলাকার মধ্যে।'
গাজীপুর-টঙ্গী: অর্ধেক যন্ত্রাংশ চালাতেই নাজেহাল
নারায়ণগঞ্জ থেকে টঙ্গীর বিসিক এলাকার অবস্থা কিছুটা মন্দের ভালো। এখন পর্যন্ত কিছু কলকারখানা তাদের উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে। কারখানাগুলো পরিচালনার জন্য মোটামুটি ৬ পিএসআই গ্যাসের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এক অথবা দুইয়ের উপরে তা কোনভাবেই উঠছে না।
টঙ্গী ও গাজীপুরের প্রয়োজনের চেয়ে অর্ধেকেরও কম গ্যাস সরবরাহ পাচ্ছে কারখানা। সরেজমিনে দেখা যায়, যেসব কারখানায় পুরো উৎপাদনে যেতে ৬ পিএসআই গ্যাসের চাপ প্রেয়োজন সেখানে সারাদিনে পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ২- ২.৫ পিএসআই। নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস না পাওয়ায় অর্ধেক যন্ত্রপাতি বন্ধ রেখে বাকি অর্ধেকে উৎপাদন করছে কারখানাগুলো। এতে সারাদিনে ২০ থেকে ২৫ বার বন্ধ হয়েছে। শিল্প মালিকরা বলছেন, উৎপাদন কমে আসায় ক্রয়াদেশগুলো পূরণ করা এবার অসম্ভব হয়ে পড়বে।
এডি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. বদরুল হাসান তসলিম বলেন, ‘আমরা মূল চাহিদার তিনভাগের দুইভাগ পূরণ করতে পারছি। ফ্যাক্টরিতে পৌঁছার আগে রাস্তার যে চাপ সেটা আমরা নিতে পারি। কিন্তু এসে যখন দেখি গ্যাসের চাপ নেই তখন সেটা আর নিতে পারি না। কারণ এটার সাথে আমাদের রপ্তানি জড়িত। গ্যাস বিল দিতেই আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর প্রভাব বেতন, ভাতা এবং ব্যাংকের কিস্তিসহ সকল জায়গায় পড়ছে। আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে।’
রাব্বানি ওয়াশিংয়ের কারখানা ব্যবস্থাপক ইব্রাহীম খলিল বলেন, 'আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার পিস। সেখানে মাত্র ৮ থেকে ১০ হাজার পিস করতে পারছি। কারণ গ্যাসের চাপ খুবই কম। এর কারণে আমরা পণ্য সঠিক সময়ে রপ্তানি করতে পারছি না।’
সাভার-আশুলিয়া: ব্যয় সংকোচনে শ্রমিক ছাঁটাই
সাভার এবং আশুলিয়া অঞ্চলের কিছুটা ভিন্ন পরিস্থিতি দেখা গেছে। কারণ এখানকার শিল্প কারখানাগুলো শুধুমাত্র গ্যাসনির্ভর নয়। অনেক কারখানা বিদ্যুতের ওপর নির্ভর। তবে গত কয়েকমাসে ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে অনেক পোশাক শ্রমিক তাদের কাজ হারিয়েছেন।
গত বছর আমেরিকা যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে পড়েছিল তখন তাদের শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো কর্মসংস্থান। আর বাংলাদেশের প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। এমন পরিস্থিতিতে জ্বালানি ঘাটতি ব্যয় সংকোচন নীতি আরও কঠোর করবে কিনা তা নির্ভর করছে দূরদর্শী পরিকল্পনার উপর। কারণ, কর্মসংস্থানের সাথে দারিদ্র বিমোচন জড়িত।
এই জ্বালানি সংকটের সাথে গত কয়েক বছরে যুক্ত হয়েছে কাঁচামালের উচ্চমূল্য, জ্বালানির ব্যয় বৃদ্ধি ও লোহিত সাগরের উত্তাপ, সবকিছু মিলিয়ে ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করাই কঠিন হয়ে পড়বে।
বিজিএমইএ'র সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, ‘বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের বিকল্প উপায় খুঁজে বের করতে হবে যেন ফ্যাক্টরিগুলো চালু রাখা যায়। কারণ শিল্প কিংবা বিদেশি ক্রেতারা তো বসে থাকবে না। বিভিন্ন দেশের যুদ্ধ নিয়ে বিশ্বব্যাপী আমরা ঝামেলায় আছি। তার ওপর আবার আমাদের জ্বালানি সমস্যা। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে, সেক্ষেত্রে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ কঠিন হয়ে পড়বে অনেকের জন্য। কারণ আমাদের নির্ভর করতে হয় রপ্তানির ওপর।’
সারাদেশে ৪১০ কোটি ঘনফুট জ্বালানি গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। যেখানে সরবরাহ করা যাচ্ছে সর্বোচ্চ ২৬০ কোটি ঘনফুট। ২০২১ সালে সরকারের জ্বালানি গ্যাস নিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী পরবর্তী ৪ বছরে ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। যেখান থেকে প্রতিদিন অন্তত ২৮ কোটি ঘনফুট জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। সেখানে ২০২২-২৩ সালে খনন করা হয় মাত্র ৯টি কূপ। যেখান থেকে যুক্ত করা গেছে মাত্র আড়াই কোটি ঘনফুট।