কর্মব্যস্ত চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন যত কনটেইনার জাহাজ থেকে খালাস হয় তার অনেকগুলোর ভেতরেই থাকে ‘মেড ইন চায়না’ লেখা যন্ত্রাংশ, পোশাক, ইলেকট্রনিক-সামগ্রীসহ বিভিন্ন কাঁচামাল। অপরদিকে বন্দরের গেট পেরিয়ে বাংলাদেশ থেকে চীনের উদ্দেশে যাত্রা করে চিংড়ি, চামড়া, পাটজাত পণ্যসহ বিভিন্ন রপ্তানি পণ্যে ভরা কনটেইনার। তবে, যাওয়া-আসার এই চিত্রে ফুটে ওঠে দুদেশের বাণিজ্য ঘাটতি।
বিশ্ব অর্থনীতির দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ চীন এককভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। দেশের মোট আমদানি পণ্যের এক-চতুর্থাংশই চীন আসে থেক। বিপরীতে শতভাগ শুল্কমুক্ত সুবিধা পেলেও বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি প্রায় তলানিতে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে চীন থেকে আমদানি ব্যয় ছাড়িয়েছে প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার, যা মোট আমদানি ব্যয়ের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। বিপরীতে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৮৫ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য। আর তাতে বাণিজ্য ঘাটতি ছাড়িয়েছে ২ হাজার কোটি ডলার।
বড় অঙ্কের এ বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বাংলাদেশের পাশেও দাঁড়িয়েছে চীন। ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় দেশটি। বছরঘুরে বাড়ে এই সুবিধা।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের শতভাগ পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় চীনা সরকার। তবুও কাটছে না চীনের সঙ্গে বিপুল আকারের বাণিজ্য ঘাটতি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে চীনে ৬০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে দাঁড়ায় প্রায় ৬৮ কোটি ডলারে। আর তাতেই বোঝা যায়, অধিকাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার পরও দেশটিতে রপ্তানি বাড়ানো যাচ্ছে না। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে?
আরও পড়ুন:
বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা বলেন, ‘চায়না সারা পৃথিবীর জন্য সব ধরনের পণ্য তৈরি করে। সেই দেশে গিয়ে একটা পণ্য বিক্রি করতে হলে, সেই দেশের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী পণ্য তৈরি করতে হবে। চীনের সঙ্গে আমরা যদি মাল্টিডাইমেনশনাল সম্পর্কটা উন্নত করতে পারি, আমাদের পণ্য খুব স্বাভাবিকভাবেই ওখানে আরও বেশি যাবে।’
রপ্তানি ঘাটতি কমাতে কাজ করতে হবে রপ্তানি পণ্য বৈচিত্র্যকরণ, বাজার সম্প্রসারণ ও বাণিজ্য কূটনীতি বৃদ্ধিতে।
তবে কিছুটা আশা যাগাচ্ছে নতুন বিনিয়োগ। ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে চীনা বিনিয়োগ আগের বছরের তুলনায় তিনগুণ বেড়েছে। দেশটির অংশীদারিত্ব বেড়েছে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, তৈরি পোশাক, ওষুধ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, তথ্যপ্রযুক্তি ও ইলেকট্রনিক্স খাতে। কিন্তু বাংলাদেশ এর সুফল ঘরে তুলতে পারবে কি না সেটা নিয়েই উঠছে প্রশ্ন।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মহাপরিচালক মো. আরিফুল হক বলেন, ‘সর্বশেষ বিনিয়োগের যে তথ্য আমাদের কাছে আছে, চীন থেকে বিনিয়োগে আমাদের অবস্থান প্রথম দিকে। টেক্সটাইল, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য খাতে চীন থেকে আমরা বিনিয়োগ পেয়েছি এবং আগামী দিনগুলোতে অন্যান্য খাতগুলোতেও আমরা বিনিয়োগ আশা করছি। চীন থেকে বিনিয়োগ আনার জন্য আমাদের যতটুকু চেষ্টা করা যায়, আমরা করছি।’
মামুন মৃধা বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা লোকাল পলিটিশিয়ান ও সরকারি দপ্তরগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে। তো প্রতিটি ধাপে যদি আপনি তাকে একটা স্মুথ বিজনেস রান করার নিশ্চয়তা দিতে না পারেন, যেটা আপনার কম্পিটিটররা এনশিয়র করছে, তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই সে যেখানে বেশি সুবিধা পাবে, সেখানেই তার বিনিয়োগ নিয়ে চলে যাবে।’
চীনের উত্থান কেবল বৈশ্বিক অর্থনীতিতেই নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারসাম্যপূর্ণ টেকসই অংশীদারত্ব নিশ্চিত করা গেলে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেন হতে পারে বাংলাদেশের পরবর্তী প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি।





