মোহাম্মদপুরের একজন বাসিন্দা আশরাফুন নিহার। গ্যাস না থাকায় প্রতিদিন সকালে নাস্তা তৈরি করা-ই তার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। সন্তানের টিফিন পর্যন্ত দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। কেবল সকাল নয়, দিনের অধিকাংশ সময়-ই থাকে না গ্যাস।
আশরাফুন নিহার বলেন, ‘বাচ্চার নাস্তা, হাজব্যান্ডের ব্রেকফাস্ট, টিফিন, এতকিছু হয়ই না। সাড়ে ৭টার ভেতরে গ্যাস এত লো হয়ে যাচ্ছে, যে দুপুরের রান্নার কথা তো চিন্তাই করতে পারি না।’
রাজধানীর উত্তরখান, দক্ষিণখান, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ভাটারা, রামপুরা, বনশ্রী, তেজগাঁও, শাহজাহানপুর এবং পুরান ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় চলছে গ্যাসের চরম সংকট। ফলে একদিকে যেমন গ্রাহকদের খরচ বাড়ছে, তেমনি ব্যাহত হচ্ছে তাদের স্বাভাবিক জনজীবন।
এক ভুক্তভোগী জানান, বিল ঠিকমতো দিলেও গ্যাস প্রায় থাকেই না। বিল দেয়ার পরও বাইরে থেকে খাবার এনে খেতে হয়, এতে আয় থেকে ব্যয় বেড়ে যায়।
সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা বেলায় গ্যাস আসে, তারপরও জ্বলে মিটমিট করে—বাসাবাড়ির এমন সংকট উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সবখানেই বিদ্যমান। এক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে—এ সংকট কি সংক্রমিত হয়েছে শিল্পকারখানাগুলোতেও?
আরও পড়ুন:
শিল্পখাতে গ্যাসের সংকট বহু পুরনো। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া, ভালুকা, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জসহ সব প্রধান শিল্পাঞ্চলেই কমে গেছে গ্যাসের সরবরাহ।
এতে পোশাকশিল্প, সিরামিক, সিমেন্ট খাতের মতো গ্যাস-নির্ভরশীল খাতগুলোয় কমেছে উৎপাদন। পরিস্থিতি সামাল দিতে অনেক ব্যবসায়ী এখন বাধ্য হয়ে ঝুঁকছেন বিকল্প জ্বালানির দিকে।
মিংদা (বাংলাদেশ) নিউ ম্যাটেরিয়াল কোম্পানি লিমিটেডের সিইও একেএম শোয়েব বলেন, ‘যে ধরনের গ্যাসের সংকট এখন দেখা যাচ্ছে, সেখানে আমরা দেখেছি যে অর্ডার ডেলিভারি ইন টাইম দিতে পারছে না। এখনই চিন্তা করতে হবে যে, গ্যাসের অল্টারনেটিভ যে সোর্সগুলো রয়েছে, সেই সোর্সগুলোকে ডেভেলপ করা দরকার।’
ম্যানেল ফ্যাশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশিদুল হাসান চাঁদ বলেন, ‘অলরেডি দুইটি প্রোজেক্টে আমি গ্যাস বয়লার থেকে জুট বয়লারে ট্রান্সফার করেছি, আমি ন্যাচারাল গ্যাস আর ব্যবহার করছি না। এজন্য করছি না, কারণ যে সময়টায় গ্যাস থাকে না, সে সময়টা আমাদের সিলিন্ডার দিয়ে ফ্যাক্টরি রান করতে হয়। সেটা আমাদের জন্য ব্যয়বহুল এবং রিস্ক।’
তিতাস বলছে, বিদ্যুৎ ও শিল্পখাতে গ্যাসের সংকট সমাধানকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার। মন্ত্রণালয়ের নীতিগত সিদ্ধান্তে কমানো হচ্ছে বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহের হার।
আরও পড়ুন:
এদিকে স্বল্প জনবল নিয়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করাও কার্যকরভাবে সম্ভব হচ্ছে না বলে জানায় বিতরণ প্রতিষ্ঠানটি।
তিতাসের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) প্রকৌশলী কাজী মোহাম্মদ সাইদুল হাসান বলেন, ‘সাপ্লাই আমাদের একটু কম এখন এই মুহূর্তে কারণ এলএনজি বেইজড আমাদের এখন অনেকটা হয়ে যাচ্ছে। ৩৫ শতাংশের মতো এলএনজি ইম্পোর্ট করে আমরা চালাচ্ছি। সেক্ষেত্রে এলএনজি আমদানিতে সরকারের যে নীতিমালা বা পরিকল্পনা, সে অনুযায়ী বিদ্যুতের ডিমান্ডটা যখন খুব বেশি থাকে গরমকালে তখন এলএনজির পরিমাণটা বৃদ্ধি করে, আনে সরকার।’
তিনি বলেন, ‘সারা বছরে টোটাল ইকুয়াল ডিস্ট্রিবিউশন যে আনা হয় তা কিন্তু নয়, কিছুটা কম এলএনজি আনা হচ্ছে। সেকারণে শীতকালে বিদ্যুতের ডিমান্ড কমে যাচ্ছে। বাসাবাড়িতে যদি আমাকে পুরোপুরি দিতে হয় গ্যাস, তাহলে আমাকে অন্য যে প্রায়োরিটি সেক্টর আছে, প্রথম প্রায়োরিটি বিদ্যুৎ, সার, ইন্ডাস্ট্রি— এগুলোতে কমিয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি সিদ্ধান্তের কিছু বিষয় আছে।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকার আমার ডিমান্ড হলো, ১৫০-৬০ মিলিয়ন গ্যাস দিলে আমার যে বৈধ কাস্টমার আছে, কোনো সমস্যা নেই। আমি ১৭০-৮০ দিয়েও কাভার করতে পারছি না, কারণ কী? সব অবৈধ নিচ্ছে।’
বাসাবাড়িতে গ্যাস না দিয়ে মাস শেষে টাকা নেয়া মানবাধিকারের চরম লুণ্ঠন বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা অভিযোগ করেন, এলপিজির বাজার সম্প্রসারণই তাদের মূল লক্ষ্য।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘এ সেক্টরে গ্যাসের ব্যবসা, অর্থাৎ এলএনজির ব্যবসা তৈরি করার জন্য ইম্পোর্টার, তারা উঠে পড়ে লেগেছে। একদিকে গ্যাস দিচ্ছে না, আরেকদিকে তারা পুরো পয়সা নিচ্ছে। এর থেকে অবিচার আর কী করতে পারে? এটাকে চরম লুণ্ঠন ছাড়া আর কী বলা যায়? যে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এসব কথাবার্তা বলে, তাদের কোমরে দড়ি বেঁধে আনা উচিত।’
আরও পড়ুন:
সরকারকে ব্যবসা করার নীতি থেকে সরে এসে জ্বালানিকে সেবা খাত হিসেবে ব্যবহার করারও পরামর্শ দেন এ বিশেষজ্ঞ।
সার কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ কমিশনের প্রস্তাবিত ১৫০ শতাংশ দাম বৃদ্ধিকে ‘ভুল নীতি’ বলেও আখ্যা দেন তিনি।
ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘যখন সারের দাম বেড়ে যাবে, তখন খাদ্য উৎপাদন কোত্থেকে হবে? আর খাদ্য উৎপাদন না হলে সেটাও কি সরকার আমদানি করে নিয়ে আসবে? এ প্রক্রিয়ায় সরকার তো খাদ্য সংকটে ফেলবে, দুর্ভিক্ষ ডেকে আনবে।’
সরকার নীতিগত জায়গা যদি পরিবর্তন না করে নিজেই ব্যবসায়ী হয়ে উঠতে চায়, সেক্ষেত্রে সংকট সমাধান সম্ভব নয় বলেও মনে করেন তিনি।
দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা অন্তত বিশ কোটি ঘনফুট। তবে এলএনজিসহ বর্তমানে সরবরাহ হচ্ছে দিনে ২৫০ থেকে ২৭০ কোটি ঘনফুট। ফলে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ১৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি থেকেই যায়।





