স্বজন ফেরার অপেক্ষায় এক যুগ। গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে যারা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তারা আজও ঘরে ফেরেনি।
২০১৩ সালের নভেম্বরে গাড়িচালক আব্দুস সালামকে ধরে নিয়ে যায় সাদা পোশাকধারী কজন। ৫ বছরের সংসার জীবন, আর এক যুগ ধরে স্বামীর অপেক্ষায় মিনু আক্তার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া বড় ভাইকে হারিয়ে আজও স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান লাবনি আক্তার। এরই মধ্যে কেটে গেছে ১২ বছর।
গুমের ঘটনা তদন্তে দেশের ইতিহাসে প্রথম কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। যেখানে ২০১০ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের পাঁচই আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনায় ১৮শ'টি অভিযোগ পায় কমিশন। এরমধ্যে ৪শ' টি অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ র্যাবের বিরুদ্ধে।
২৬টি ঘটনায় ডিরেক্টরেট জেনারেল ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স , ৫৫টি ঘটনায় গোয়েন্দা শাখা, ২৫টি ঘটনায় পুলিশ ও ৬৮টি ঘটনায় অন্যান্যদের সংশ্লিষ্টতা পায় কমিশন।
এদিকে গুম হওয়াদের অনেকে বেঁচে ফিরলেও ৩ শতাধিক ব্যক্তি এখনও নিখোঁজ। যাদের কেউ কেউ ভারতের কারাগারে থাকতে পারে বলে অনুমান করছে গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশন।
গুম তদন্ত কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন বলেন, ‘অনেককে বাংলাদেশে দীর্ঘসময় গুম করে রাখা হয়েছে, তারপর চালান দেয়া হয়েছে ভারতে। এবং ভারতের কারাগারগুলোতে তাদের অবস্থান অনেকের ছিল, মুক্তি পেয়েছেন, অনেকে কারাগারে আছেন এরকম তথ্য আমরা পাচ্ছি। ফলে দুই দেশের মধ্যে এক ধরনের ব্যবস্থা চালু ছিল। যে এই দেশের অপরাধীদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে সময়ক্ষেপণ করে যখন এটা সামাল দেয়া যাচ্ছিল না তখন ভারতে পাঠিয়ে দেয়া এবং ভারতের অপরাধীদের এখানে পাঠিয়ে দেয়া।’
মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ শাসনামলে দেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার ২ হাজার ৬৯৯ জন। ২০২৪ এ গণহত্যা যোগ করলে এ সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৪ হাজারে। ঘটনার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নির্বাচনের আগে বিচার বহির্ভূত হত্যার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
জোর করে ক্ষমতা দখল ও ভয়ের সংস্কৃতি কায়েম করতেই খুন-গুম করা হয়েছে বলে অভিযোগ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর। গোপন বন্দিশালা উন্মুক্ত করার দাবি তাদের।
মায়ের ডাক সংগঠনের সানজিদা আক্তার তুলি বলেন, ‘এত অত্যধিক হারে মানবাধিকার লঙ্ঘন আমার মনে হয় ইতিহাসে আমাদের আশেপাশেও কোথাও হয় নি। প্রতিটা নির্বাচনের আগে এটা এত বড় আকারে করা হয় যে মানুষ চুপ হয়ে যায়।’
তিনি আরো বলেন, ‘তৎকালীন আওয়ামী অপশক্তির উপরের কিছু মানুষ হয়ত চলে গেছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে কাঠামো তো এখনো রয়েছে।’
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করা হয়েছে কঠোরভাবে। বন্ধ বা দখল করে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে গণমাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও শেখ হাসিনা বা শেখ মুজিব বিরোধী বক্তব্য দেয়ায় মামলা ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ১৫ বছরে ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি বেছে নেয়ার অধিকার পায়নি জনগণ।
নূর খান বলেন, ‘এরকম একটা অবস্থায় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য ধরে রাখার তারা সবদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন। সমাজের ভয়ের সংস্কৃতি বহমান রাখা হয়েছে। যাতে কেউ সরকারের বিরুদ্ধে টু শব্দটি না করতে পারে। কেউ যাতে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারে।’
তিনি বলেন, ‘তারা এ ঘটনা ঘটাতে সাহায্য করেছেন, নির্দেশ দিয়েছেন এবং ঘটনার দায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বা তার মন্ত্রী পরিষদ এড়াতে পারবেন না।’
এদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গুম সম্পর্কিত ধারা যুক্ত হওয়ার পরে প্রতিনিয়ত জমা হচ্ছে অভিযোগ। এখন পর্যন্ত ৭০টি গুমের অভিযোগ জমা পড়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তারেক আব্দুল্লাহ বলেন, ‘যেহেতু আমাদের এখন আইনি সুযোগ তৈরি হয়েছে, যারা যে অবস্থায় গুম হয়েছে আমরা চাইলে এটা অ্যাটেইন করতে পারব।’
জুলাই-আগস্টে গণহত্যার বিচারের পর গুমের বিচারকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সংবিধানে প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার Sনিশ্চিতের উল্লেখ থাকলেও গত ১৫ বছরে বার বার ক্ষমতার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছ মৌলিক মানবাধিকার।
শুধু ভিন্নমতের কারণে প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের ব্যবহার করে এসব বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুম, খুনের ঘটনা ঘটেছে। যারা বারবার আদালতের বারান্দায় ঘুরলেও বিচার পাননি, কেউ বা মামলা করার সাহস পায়নি।
এখন সময় এসেছে প্রতিটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার করার, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কোনো সরকার বা কোনো বাহিনীর লোক এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সাহস না পায়।