বিএসএফের ছোড়া বুলেটে, বিদ্ধ কিশোরীর বুক। মৃত্যু হলেও যেন মুক্তি মেলেনি। প্রাণহানির পরও কাঁটাতারে ঘণ্টা পাঁচেক উল্টো হয়ে ঝুলে থাকতে হয়েছে নিথর ফেলানিকে।
২০১১ সালের জানুয়ারি, কুড়িগ্রামের অনন্তপুর-দিনহাটা সীমান্তের খিতাবেরকুঠি এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএসফের হাতে প্রাণ হারিয়ে কেবল ফেলানি নয়, ঝুলে ছিল পতিত আওয়ামী লীগের ভারতের প্রতি নতজানু নীতির প্রতিচ্ছবি। নির্মম এই মৃত্যুতে কুড়িগ্রামের ফেলানি দেশের বিবেকবান আপামর জনতার হৃদয়ে জ্বালিয়েছিল বহ্নিশিখা।
ফেলানির মা বলেন, ‘আমার মেয়ের বিচার যেন হয়। হইলে আর বাংলাদেশের লোকজনের মারবে না।’
ফেলানির ভাই বলেন, ‘যে আমার বড় বোনকে মারছে তার যেন অনেক বড় শাস্তি হয়।’
কেবল ফেলানি নয়, গেল ১৪ বছরে বিএসএসফের গুলিতে নিহত বাংলাদেশি প্রায় ছয় শতাধিক। আওয়ামী লীগের সবশেষ আমলে পাঁচ বছরে নিহত ১৬২ জন। এ পরিসংখ্যানে কেবল ২০২৪ সালে বিএসএফের হাতে সীমান্তজুড়ে যে প্রাণহানি হয়েছে, সেখানে একক বিভাগ হিসাবে রংপুরের তিন জেলায় প্রাণহানি সর্বোচ্চ।
বিভাগের তিন জেলা লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও আর পঞ্চগড় সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর গুলিতে প্রাণ গেছে ১০ জন নাগরিকের।
পট পরিবর্তন পর পতিত সরকারের করা অসম চুক্তি ঘিরে বিএসএফের তৎপরতায় আতঙ্ক ছড়ায় সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে।
সীমান্ত গ্রামের নাগরিকদের একজন বলেন, ‘আমরা তো চোরাচালান করি না। গরু বাচুর মাঠে চড়ায়। তাও সেখানে যেত ভয় লাগে।’
গেল কয়েক বছরের ঘটনা পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ভারতের সঙ্গে রংপুর বিভাগের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাট। ২০২৪ সালে কেবল এ জেলা থেকেই বিএসএফের গুলিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন ৫ জন বাংলাদেশি। এছাড়া পঞ্চগড়ে ৩ জন ও ঠাকুরগাঁওয়ে ২ জন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে।
এক বছরে কেবল রংপুর বিভাগের তিন জেলাতেই প্রাণ গেছে ১০ জনের। এছাড়া শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম ইউনিয়নের শূন্যরেখায় আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘যদি সীমান্তে কারো গতিবিধি যদি সন্দেহজনক হয় তাহলে তাকে গ্রেপ্তার করা যেতে পারে। কিন্তু সেই মানুষকে যদি ঠান্ডা মাথায় গুলি করে তারা এটি প্রমাণ করে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের নেতিবাচক মনোভাব থেকে এইটা করে থাকে।’
রংপুর বিভাগের সঙ্গে উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের সীমান্ত ২৭৮ কিলোমিটার দীর্ঘ। এদিকে ১৫৬ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকার জেলা ঠাকুরগাঁও গেলো বছর নিহত হয়েছেন ২ জন। ৩ জন নিহতের ঘটনা আছে পঞ্চগড়ে।
সেখানে ২০২৪ এর মে মাসেই হত্যা করা হয় দুজনকে। এছাড়া বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অধিকার এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব বলছে, বিএসএফ এর হাতে আওয়ামী লীগের প্রথম দফার শাসনামলে ২৭০ পরের দফায় ১৪৬ আর সবশেষ আমলে সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক নিহতের সংখ্যা ১৬২ জন।
একই সংস্থার আরেক হিসাবে উঠে আসে ২০১১ থেকে ২০; নয় বছরে নিহত-আহতসহ ভারতীয় সীমান্তে নিপীড়িত এদেশের নাগরিকের সংখ্যা ১ হাজার ৪৮৬ জন। যার বেশিরভাগ ঘটনাই সংঘটিত হয়েছে দেশের উত্তর জনপদের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোয়।
শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ত্বহা হুসাইন বলেন, ‘ভারত বিরোধী যে প্রচারণা বাংলাদেশে চলছে বা ক্যাম্পেইনগুলো চলছে সেটার ব্যাপার ভারত থেকে অনেকবার বলেছে। এইটা আমার কাছে মনে হয় সীমান্তে ভারতের হত্যা বন্ধ করতে হবে।’
আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, সীমান্ত লাইনের দেড়শ গজের মধ্যে কোনো অবকাঠামো বা কর্মকাণ্ড করতে হলে অপরপাশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে জানানোর নিয়ম থাকলেও, সম্প্রতি লালমনিরহাটের পাটগ্রামে একক সিদ্ধান্তে কাঁটাতারের বেড়া ও ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার রত্নাই সীমান্তে পাহারা চৌকি বসিয়ে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে বিএসএফ।
সচেতন মহলের ভাষ্য, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক টেকসই করতে একদিকে যেমন দরকার পারস্পরিক সমতায়নের ভারসাম্যপূর্ণ স্বার্থ, তেমনি প্রয়োজন এসব হত্যাকাণ্ডের যথাযথ জবাবদিহিতা। তবে সে পথ কতটা সুগম হয়, তা জানতে অপেক্ষা দুই দেশের সীমান্ত সম্মেলনের সিদ্ধান্ত পর্যন্ত।