জাতিসংঘের প্রতিবেদন: বিদেশে শেখ হাসিনাসহ পালিয়ে থাকাদের বিচার সম্ভব

বিশেষ প্রতিবেদন
দেশে এখন
0

জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনের পর, মানবতাবিরোধী অপরাধে বিদেশের মাটিতেও শেখ হাসিনাসহ পালিয়ে থাকা আসামিদের বিচার সম্ভব বলে মত দিচ্ছেন আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা এও বলছে, এই প্রতিবেদন, পালিয়ে যাওয়া অপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে শক্ত প্রমাণ হিসেবে কাজ দেবে। একইসঙ্গে তারা আরও বলছেন, এই তথ্যানুসন্ধান প্রক্রিয়ায়, আওয়ামী লীগ দলগতভাবে এবং নেতারা ব্যক্তিগতভাবে অংশ নেওয়ায় জুলাই আগস্টে ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থান দমনে পরিচালিত গণহত্যাকে, অস্বীকার করার আর কোন সুযোগ রইলো না।

জুলাই আগস্ট জুড়ে বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ডসহ চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর, আদৌ বিচার হবে কি না, এমন শঙ্কা আর বিতর্কের বাক বদল করে দিয়েছে জাতিসংঘ সদর দপ্তর থেকে প্রকাশিত এই তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন।

ঐ ঘটনার ২৩০ ভুক্তভোগী কিংবা সাক্ষী এবং ৫ আগস্টের আগে ও পরে দায়িত্ব পালন করা ৩৬ কর্মকর্তার সাক্ষ্য, ১৫০টি মেডিকেল কেসের বিশ্লেষণ এবং কয়েক হাজার ছবি ও ভিডিও যাচাই বাছাই করে, তথ্যানুসন্ধান দল, যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তার ৫ নম্বর পাতায় আছে, এসব সহিংসতায় নির্যাতন চালানো বাহিনী এবং তাদের নির্দেশদাতাদের নাম।

এখানে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং অন্যান্য সূত্রগুলো থেকে প্রাপ্ত সাক্ষ্য ও তথ্যের ভিত্তিতে ওএইচসিএইচআর এটা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে, সমগ্র পুলিশ বাহিনী, আধা-সামরিক, সামরিক এবং এদের গোয়েন্দা বিভাগ, আওয়ামী লীগের সহিংস গোষ্ঠীর সঙ্গে সমন্বিত এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের যে ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে, তাতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পূর্ণ জ্ঞান, প্রত্যক্ষ নির্দেশনা ও সমন্বয় ছিল।

এখানে আরও বলা হয়েছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একইভাবে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা স্থাপনাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় সাধন করেছেন। ঐ ঘটনার সময় উভয়ই মাঠ পর্যায়ের পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন পেতেন।

প্রতিবেদনের ৭৪তম পাতায়, এসব অপরাধকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, ওএইচসিএইচআর এর কাছে যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে এটা বিশ্বাস করতে যে, হত্যা, নির্যাতন, অন্যান্য অমানবিক কর্মকাণ্ডসহ ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিগত সরকার তাদের দমন নীতির আওতায় বিক্ষোভকারী, সম্ভাব্য বিক্ষোভকারী, বেসামরিক নাগরিকদের ওপর পদ্ধতিগতভাবে যেসব অমানবিক কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে তা মানবতাবিরোধী অপরাধ।

এর ৩ নম্বর পাতায়, এসব অপরাধ তদন্তের তাগাদাও দেয়া আছে। বলা হয়েছে, এই গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের দৃষ্টিকোণ থেকেও উদ্বেগের কারণ, কিন্তু এটি মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে কোন মাত্রার সেটি নিশ্চিত হতে তদন্তের প্রয়োজন।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মামলাগুলোতে একইধরনের অপরাধের অভিযোগ থাকায়, জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন, বিচার ত্বরান্বিত করার দারুণ এক সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, যার উপযুক্ত ব্যবহারে মুন্সিয়ানা দেখাতে হবে প্রসিকিউশন টিমকে।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শরীফ ভূইয়া বলেন, ‘আমাদের দেশে যে বিচার হচ্ছে সেখানে এটা কাজে লাগবে। কারণ এটা সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিসংঘ। ওনারা একটা নিরপেক্ষ তদন্ত করেছেন। এখন বাংলাদেশে ১০০ ভাগ নিরপেক্ষ তদ্ন্ত করলেও লেভেল দেয়া সম্ভব না।’

আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ কাজী ওমর ফয়সাল বলেন, ‘ তথ্য তৈরি করার যে প্রক্রিয়া এখানে আওয়ামী লীগ নিজেও কিন্তু অংশগ্রহণ করেছে। তাদের যে ফেসবুক পেজ আছে সেখানে তারা বলেছে আপনারা এখানে তথ্যগুলো দেন।’

কিন্তু জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া অভিযুক্তদের ব্যাপারে কি কোনো কাজে আসবে। এর উত্তর পাওয়া যায়, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনারের এই বক্তব্য থেকে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার ভলকার টুর্ক বলেন, ‘একটা ব্যাপার আলোচনায় আছে, যখন কেউ গুরুতর অপরাধ করেছে কিন্তু দেশের বাইরে অবস্থান করছে তার বিচার নিয়ে। এক্ষেত্রে আমি মনে করি, ‘ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশন’ কাজ করতে পারে। যেসব দেশে "ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশন" সম্ভব সেসব দেশে এসব ব্যক্তিকে জবাবদিহিতায় আনার একটা উপায় হতে পারে। এবং অবশ্যই আমি উল্লেখ করবো, এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কথা, কারণ বাংলাদেশ রোম স্টাটিউটে স্বাক্ষর করা একটি দেশ।’

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক্ষেত্রে জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন, গণহত্যার অপরাধীদের বিদেশি রাজনৈতিক আশ্রয় নেবার ক্ষেত্রেও বাঁধা হয়ে দাড়াতে পারে।

কাজী ওমর ফয়সাল বলেন, ‘এমন অনেক কেস আছে। ইরাক থেকে গিয়েছে, সিরিয়া থেকে গিয়েছে, আফগানিস্তান থেকে ইউরোপে অ্যাসাইলাম চেয়েছে পরবর্তীতে বিচার হয়েছে। প্রচুর উদাহরণ আছে।’

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শরীফ ভূইয়া বলেন, এ ডকুমেন্ট আমাদের সরকারের হাতকে আরো শক্তিশালী করবে বলে আমি মনে করি।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান কৌসুলি বলছেন, তারা সব দিক মাথায় রেখেই আগাচ্ছেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান কৌসুলি মো. তাজুল ইসলাম বলেন, তদন্ত সংস্থার কাছে প্রাপ্ত যে অভিযোগ ও আমাদের কাছে যে প্রাপ্ত তথ্য সেটার সাথে এ প্রতিবেদনের মিল রয়েছে।

জাতিসংঘের ১১৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জুলাই আগস্ট আন্দোলন দমনে ১৪শ'র মত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে প্রতি ৫ জনের ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে গুলিতে। এছাড়া মৃত্যু হওয়া প্রতি জনের একজন শিশু। এবং এই আন্দোলনে আহতের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার।

এএইচ