চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের আউটডোর। টিকেট কাউন্টারগুলোর সামনে সেবাপ্রার্থীদের দীর্ঘ সারি। সাথে হট্টগোল, বাকবিতণ্ডা বা রোগী স্বজনের দ্বিগবিদিক ছোটাছুটি। টিকেট দেয়া থেকে ল্যাব রিপোর্ট পাওয়া, কোন পরীক্ষা কোথায় হয়, কিংবা জরুরি তথ্য প্রাপ্তি। এসব নিয়ে নিয়মিতই মেলে বিস্তর অভিযোগ।
রোগী স্বজনদের একজন বলেন, ‘পরীক্ষা তো ভালো পাচ্ছেন কিন্তু টিকেট ক্রয় ও রিপোর্ট ডেলিভারি যদি ঠিক হতো তাহলে সব কিছু ঠিক হয়ে যেত।’
আরেকজন বলেন, ‘দীর্ঘ লাইন। আমরা ৪ তলা থেকে লাইন ধরতে ধরতে তিন তলা সিঁড়িতে চলে আসছি।’
অভিযোগের পরও প্যাথলজি ল্যাবে প্রতিদিন সেবা নিতে ছুটে আসেন প্রায় হাজার খানেক মানুষ। পরীক্ষাও হয় আড়াই থেকে তিন হাজার। জানালেন, দুর্ভোগ থাকলেও বাইরের ডায়াগনস্টিকের চাইতে তিন থেকে চারগুণ কম মূল্যে পরীক্ষা করা যায় এখানে। তাই এটি নিম্ন বা মধ্যবিত্ত মানুষের ভরসার জায়গা।
রোগী স্বজনদের একজন বলেন, ‘অন্যসব হাসপাতালে ব্যয় বেশি এখানে ব্যয় কম।’
দেখে মনে হতে পারে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক বা হাসপাতালের অত্যাধুনিক কোন ল্যাব। অথচ উন্নত মানসম্পন্ন এসব যন্ত্রে সজ্জিত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষটি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সরকারি ল্যাব। প্রতিষ্ঠানটির বহির্বিভাগের বাইরের চিরচেনা হট্টগোল, ভিড় কিংবা রোগী স্বজনদের নানা অভিযোগ পেরিয়ে ভেতরে যে এমন একটা ল্যাব সাধারণের রোগ নির্ণয়ে দিনরাত সচল রয়েছে তা অনেকেরই অজানা।
বাইরের বেসরকারি ডায়াগনস্টিক বা হাসপাতালে আছে বাড়তি ব্যয় সাথে মাঝেমধ্যে ভুল রিপোর্টের বাড়তি দুর্ভোগ। সেখানে তিন থেকে চার গুণ এমনকি কিছু পরীক্ষায় ১০ থেকে ২০ গুণ কম খরচে অনেকটা নির্ভুলভাবে এই ল্যাব থেকে আপনি করাতে পারবেন ৫৬ রকম সাধারণ ও জটিল নানা পরীক্ষা।
চমেক হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের ইনচার্জ শুভাশীষ বড়ুয়া বলেন, ‘এখানে একটা সিভিসি হচ্ছে দুইশ টাকা বাহিরে সেটা ৬শ’ টাকা।’
সিবিসি পরীক্ষা থেকে আরবিএস পরীক্ষা, লিপিড প্রোফাইল থেকে ইউরিক অ্যাসিড প্রায় সব প্যাথলজিকাল সেবায় এখানে মেলে। হাসপাতালে গত কয়েক বছরে যেসব বিভাগ আধুনিকায়ন হয়েছে তার মধ্যে এই ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগ অন্যতম। এখানে দুই বছর আগে বাড়ানো হয়েছে টিকেট বুথ, স্যাম্পল কালেকশন বুথ, ও কর্মীদের শিফট। এতে পাঁচ বছরের ব্যবধানে এই বিভাগে আয় বেড়েছে অন্তত ৪ গুণ। ১৯-২০ অর্থবছরে দেড় কোটি টাকার আয় এখন দাড়িয়েছে ৬ কোটি ৩৮ লাখে।
হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগে মেলে সিটি স্ক্যান, এক্স রে, আলট্রাসনোগ্রাফি বা এম আর আইয়ের মতো জটিল সেবা। এই বিভাগে এলে চোখে পড়ে সংকটাপন্ন, গুরুতর আঘাত পাওয়া জরুরি রোগিদের ভিড়। গত ৫ বছরে এই বিভাগ থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ২৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। রোগী ছিল ৭ লাখ ৮৮ হাজার জন। অর্থাৎ বছরে গড়ে প্রায় ৫ কোটি টাকা আয় হয়েছে এ বিভাগেও।
চমেক হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের আলী আজম বলেন, ‘আমরা সিটি স্ক্যান করি যেটা ২ হাজার টাকা। এই পরীক্ষাটা বাহিরে ৪ হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা নেই।’
চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে আয়ের বড় অংশ আসে মূলত প্যাথলজি, রেডিওলজি, ও কার্ডিওলজি বিভাগ থেকে। গত তিন বছরে সরকারি এই হাসপাতালে মোট রাজস্ব বেড়েছে প্রায় দেড় গুণ। আর গত বছর এখানকার বিভিন্ন ল্যাবে সেবা নিয়েছেন ৬ লাখেরও বেশি রোগী।
এ আশাজাগানিয়া গল্পে বোঝা যায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হতে পারতো এ অঞ্চলের মানুষের রোগ নির্ণয়ে টেস্ট ও সেবার মূল ভরসাস্থল। অথচ প্রচারের অভাবে মেডিকেলের কম মূল্যের এসব সেবার কথা জানেনা অনেকেই। তারা ছুটে যায় বেসরকারি ক্লিনিকে।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে দক্ষ জনবল, অবকাঠামো সংকট ও বিকল যন্ত্র। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বছরের পর বছর অকেজো পড়ে থাকে প্রয়োজনীয় অনেক যন্ত্র।
রেডিওলজি বিভাগে গত দুই বছর ধরে স্তন টিউমার/ক্যান্সার নির্ণয়ের ম্যামোগ্রাফি মেশিনটি অচল পড়ে আছে। নষ্ট হয়ে আছে অতি গুরুত্বপূর্ণ এমআরআই মেশিন। তাছাড়া ৪ টি আলট্রাসনোগ্রাফি মেশিন, ৪ টি এক্সরে মেশিনসহ দীর্ঘদিন অচল পড়ে আছে হাসপাতালের প্রায় ২০ কোটি টাকার নানা গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র। এসব যন্ত্র একবার নষ্ট হলে মেরামতে কয়েক কোটি টাকা লাগে। তাই মেরামত বা নতুন যন্ত্র পাওয়ার আবেদন বাজেট জটিলতায় উপরে গিয়ে থমকে থাকে। আর অসংখ্য চিঠি দেয়ার পরও জনবলও নিয়োগ থমকে আছে।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন বলেন, ‘৫শ’ বেডের হাসপাতাল থেকে এখন ২২শ’ বেডের হাসপাতালের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কিন্তু ৫শ’ বেডের জনবল দিয়ে এই কাজ করতে হচ্ছে। এই বিষয়ে অনেক চিঠি দেয়া হয়েছে।’
হাসপাতালের বিভিন্ন ভবনজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্যাথলজি, রেডিওলজি বা কার্ডিওলজিকে নির্মাণাধীন একটি ভবনে এক ছাদের নিচে আনার পরিকল্পনা ছাড়াও বিভিন্ন পরীক্ষার রিপোর্ট অনলাইনে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।