দুর্গামা ওলামিক, মৌলভীবাজারের ন্যাশনাল টি কোম্পানি লিমিটেডের অন্তর্ভুক্ত চাম্পা রায় বাগানের একজন চা শ্রমিক। ৪০ বছরের কাজে কখনো তিনি বেতন ছাড়া থাকেননি। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে তিনি তার কাজ চালিয়ে গেলেও গত ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ যাবৎ কোনো মজুরিই দেয়া হচ্ছে না তাকে। ফলে পড়েছেন বিপাকে।
তিনি বলেন, বাচ্চারা স্কুলে গেলে টাকা চায়, কই থেকে দিব। মহাজনও দেয় না। ধান ও নাই যে কুটে খাব। ধান যার আছে তার তো তেল, লবণ লাগবে।’
দুর্গামার মতো ন্যাশনাল টি কোম্পানির ১২টি বাগানের প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক এখন অর্থসংকটে। শুধু মজুরি সংকট যে তাই নয় গত এক বছরেরও বেশি সময় তাদের রেশন, বোনাসসহ প্রভিডেন্ট ফান্ডের প্রাপ্যতাও হয়েছে অনিয়মিত। ফলে এসব শ্রমিকের ওপর নির্ভরশীল ৫০ হাজার মানুষ এখন বিপদের সম্মুখীন।
ন্যাশনাল টি কোম্পানির বার্ষিক মূল্যায়নপত্র সূত্রে জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত ৫ বছরে বাগানগুলোর উৎপাদন বেড়েছে ঠিকই কিন্তু সাথে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে তাদের লোকসানের পরিমাণও। যার পরিমাণ ২১৫ কোটি টাকা।
কর্তৃপক্ষ বলছে ২০২৩-২৪ সালে এসে তাদের ব্যাংকের কাছে ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮০ কোটিতে। তাছাড়া চলতি বছরে বাগান পরিচালনার জন্য কৃষি ব্যাংক থেকে ৮৬ কোটি টাকা ব্যাংক লোন নিলেও মাত্র ৭ মাসেই খরচ হয়েছে ৮০ কোটি টাকা।
যে ৬ কোটি টাকা আছে তা দিয়ে বছরের বাকি সময় বাগান চালানো সম্ভব নয়। তাই শ্রমিক মজুরিসহ বাগান পরিচালনা খাতে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, মূলত বাগান পরিচালনাকারী ব্যক্তিদের বিলাসিতা, অদক্ষতা, দুর্নীতি আর লুটপাটের কারণেই বাগানগুলোর ভগ্নদশা বলে অভিযোগ শ্রমিক নেতাদের। প্রশ্ন তুলেছেন দেশের অন্যান্য বাগানগুলো যখন সমন্বয় করে লাভের মুখে আছে সেখানে কেবল সরকার নিয়ন্ত্রিত বাগানগুলোতে লোকসান হবে কেন?
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি পঙ্কজ কন্দ বলেন, ‘এখানে সেট ট্রি নেই। এইযে অব্যবস্থাপনা, চা বাগানের যে যত্ন, এখানে যে খরচ, সে খরচগুলো যদি বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয় এবং ব্যয় করা হয় তাহলে টাকাগুলো গেছে কোথায়?’
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা বলেন, ‘এদের মধ্যে অনেকটা দুর্বলতা আছে। যেখানে লুটপাট চলে, কোনো ডিসিপ্লিন নেই। সেখারে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে না পারায় আজ এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’
যদিও ন্যাশনাল টি কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন অভিযোগ সঠিক নয়। তবে নতুন করে কোম্পানি নিয়ে ভাবছেন তারা।
ন্যাশনাল টি কোম্পানির জিএম এমদাদুল হক বলেন, প্রত্যেকটা কর্মকর্তাকে আরো পরিশ্রম করতে হবে। সঠিকভাবে মনিটরিং করতে হবে। সব ক্ষেত্রে কাজগুলো সঠিকভাবে হলে যখন যা প্রয়োজন সেটা প্রয়োগের বিষয়ে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা, প্রয়োজনের তুলনায় বেশি শ্রমিক আর অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণেই মূলত অর্থসংকট দেখা দিয়েছে কোম্পানিটিতে। আয়ব্যয় সামঞ্জস্য না করে এভাবে চলতে থাকলে বাগানের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিবে বলে অভিমত তাদের।
বছরে গড়ে তারা ৫ থেকে ৮ কোটি টাকা লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আরো সংকট তৈরি হবে কোম্পানিটির। তাই সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদি স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করা যায় তাহলে চলমান সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।