ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল এবার চোখে পড়ার মতো। বিপ্লবে-স্লোগানে উচ্চকিত কণ্ঠস্বর যেমন ছিল, তেমনি রাস্তায়-দেয়ালে গ্রাফিতি, চিত্রাঙ্কনেও ছিল কাঁধে কাঁধ মেলানো উপস্থিতি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সাম্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রইলো এটিও।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা বলেন, '১৭ তারিখে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয় ছেলেরা দুপুর থেকেই হল ছেড়ে যাওয়া শুরু করে। কিন্তু আমরা যে ৫ হলের মেয়েরা ছিলাম, তারা কিন্তু দাঁত কামড়ে হলে পড়ে ছিলাম। ছেলেদের একটা গণগ্রেপ্তারের ভয় ছিল, তাদের ওপর নির্যাতন বেশি হচ্ছিলো। এখানে নারীদের একটা বিশার অংশগ্রহণ ছিল। সব মেয়েরাই আস্তে আস্তে যে জেলা শহরে থাকে সেখানে প্রোগ্রামগুলোতে আসা শুরু করে। আমি যেহেতু ঢাকায় ছিলাম, আমি ঢাকায় প্রোগ্রাম করি। আস্তে আস্তে মানুষ যখন তার ভয় ভেঙ্গে একটু একটু করে বের হতে থাকে তখন কিন্তু একটা গতি তৈরি হয়ে যায়।'
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম বলেন, 'নারীদের অংশগ্রহণ অভূতপূর্ব ছিল। সবাই নিজের বোনের মতো সবাই সবার পাশে থেকেছে। আমি যতদূর দেখেছি, সবাই খুব আগ্রহীই ছিল সমতার সংগ্রামটা সফল করার জন্য।'
সমন্বয়কদের ডাকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা সাড়া দিয়েছেন দারুণভাবে। বুলেট-বোমার সামনে ছিলেন নির্ভীক। নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সহ- সমন্বয়ক মাইশা মালিহা বলেন, 'আমাদের ওপর যখন গুলি বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যারা টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়ছে তাদের কাছে থেকে আমরা আসলে দৌঁড়ে পালানোর চেষ্টা করেছি। সেখান থেকে বাঁচার আর উপায় ছিল না। মেয়ে হিসেবে কোনো ছাড় পাওয়া যায়নি।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের হল সমন্বয়ক আদিবা সায়মা খান বলেন, 'আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছিলাম নিরস্ত্র। আমরা আমাদের যৌক্তিক দাবি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। যখন ইট-পাটকেল দিয়ে মেয়েদের আঘাত করা হচ্ছে, মাথা ফাটিয়ে দেয়া হচ্ছে এটা দেখেছি নিজের সামনে। এখন পর্যন্ত সেই ট্রমা থেকে বের হতে পারিনি আমি।'
কোটা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেকে স্বৈরাচার দমনের আন্দোলনে রূপ নেয়ার এই মিছিলে ঘরের বাঁধাও সহজেই ডিঙিয়েছেন অংশ নেয়া মেয়েরা।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সহ- সমন্বয়ক সানজানা আফিফা অদিতি বলেন, 'আমাদের যেটা বলা হতো যে, লিখালিখি করা যাবে না। স্বাভাবিকভাবে তারা (বাবা-মা) একটু চিন্তিত ছিল আর বিশেষ করে আমি যেহেতু মেয়ে সেটা আরও বেশি চিন্তা ছিল তাদের। ছেলেদের ধরে নিয়ে দেখা যায় হয়তো তাদের মারবে, কিন্তু মেয়েদের ধরলে একটু সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের ঝুঁকি থাকে। তখন আমি জোর করে বলেছি যে, আমার নামে মামলা হবে, আমাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে, অনেক কিছু হতে পারে, এটা মেনে নিয়েই আমি এখানে এসেছি। এখন আমি এটা মেনে নিয়ে এসেছি, তোমরা মেনে নাও, এরপর যদি মোন হয় তোমরা আমাকে সাপোর্ট দিবা তাহলে দাও। আর যদি বলো যে দিবা না, তাহলে বলো আমি বাসা থেকে বের হয়ে যাবো। আমি কোথায় থাকবো কেউ জানবে না।'
গণজমায়েতে নানান রকম হেনস্থার শিকার হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা এ দেশের নারীরা পেয়েছেন অসংখ্যবার। তবে, এবারের লাখো মানুষের আন্দোলনেও এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার মুখে পড়তে হয়নি কাউকে।
আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী একজন নারী বলেন, 'আন্দোলন আমরা যাদের সাথে করেছি, আলহামদুলিল্লাহ তাদের থেকে অনেক সুন্দর ব্যবহার আমরা পেয়েছি। তাদের থেকে কোনো হ্যাসেল পাইনি আমরা। কিন্তু আমরা অনেক সময় বাইরের লোকদের থেকে হ্যাসেলের শিকার হয়েছি। এর মধ্যে অন্যতম পুলিশ, ছাত্রলীগ, ভাড়া করো টোকাইদের থেকে অনেক সাফার করেছি।'
আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অন্য একজন নারী বলেন, 'আমাদের ওপর যখন ছাত্রলীগে ও তাদের টোকাইরা সাথে পুলিশ হামলা চালায় তখন আমাদের ভাইরা আমাদের তাদের মাঝে নিয়েছে সেফ করার জন্য। তারা আমাদের সইড করে দিচ্ছিলো যেন আমাদের কোনো ক্ষতি না হয়। তারা খুবই হেল্পফুল ছিল। কিন্তু আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পুলিশের, তারাই যদি আমাদের ওপর হামলা করে, তাহলে আমাদের তো মনে হয় না আমরা সেফ আছি।'
নারী-পুরুষ সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণে রচিত হয় ইতিহাস। পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যেভাবে বলেছিলেন, বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী-অর্ধেক তার নর। ঠিক একইভাবে স্বৈরাচারী শাসনের হাত থেকে মুক্তি এনে দিতে সমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এ দেশের নরী-পুরুষ।