জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুরুতে বিদেশমুখিতা কমিয়ে ধনী-গরীব সবার জন্য চিকিৎসা সেবা সহজলভ্য হবে এমনটা বলা হলেও এখন ব্যবসায়িক চিন্তাকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে।
চিকিৎসায় বিদেশমুখিতা কমানোসহ প্রযুক্তিনির্ভর অত্যাধুনিক সেবা নিশ্চিতে তৈরি করা হয় দেশে সরকারিভাবে প্রথম সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল। উদ্বোধনের ১ বছর ৯ মাস পার হলেও হাসপাতালটিতে এখনও পূর্ণাঙ্গ সেবা চালু করা যায়নি।
আধুনিক চিকিৎসা নিশ্চিতে হাসপাতালটির জন্য ২৮৩ কোটি টাকায় অত্যাধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতি অলস পড়ে আছে। মৌলিক পরীক্ষায় হাতেগোনা কয়েকটি যন্ত্র ব্যবহার হলেও আদতে স্বল্পমূল্যের সেবা পাচ্ছেন না সাধারণ রোগীরা। অন্যদিকে দীর্ঘদিন এসব চিকিৎসা যন্ত্র পড়ে থাকায় ব্যবহারের আগেই নষ্ট হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
প্রায়শই গণমাধ্যমের শিরোনাম হওয়া এ হাসপাতালটির অব্যবস্থাপনা, জনবল নিয়োগে অনিয়মকে দায়ী করা হচ্ছে। অন্যদিকে চাহিদার ৮৬ শতাংশ কম জনবল দিয়ে চলছে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থায়নে গড়া হাসপাতালটি। নিয়োগ জটিলতা নিরসনসহ আইন পরিবর্তন না করলে পূর্ণাঙ্গ সেবা চালু সম্ভব নয় বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদ নূরুল হক বলেন, 'এইটা ইউজিসির আন্ডারে গেলে বিএসএমএমইউয়ের আরেকটা শাখা হবে। বঙ্গবন্ধুর একটা অ্যাক্ট আছে। এই আইনের অধীনে সংযোজন করতে হবে। বঙ্গবন্ধু কর্তৃপক্ষ এক বা একাধিক সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল পরিচালনা করতে পারবে।'
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিএসএমএমইউ'র তথ্যমতে- অবকাঠামো নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি কেনা বাবদ খরচ হয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪০৩ ধরনের ৬ হাজার ৬১২টি চিকিৎসা যন্ত্র কিনতে খরচ হয় প্রায় ২৮৩ কোটি টাকা।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, পরিচালনার জন্য চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রয়োজন অন্তত ২ হাজার ৭০০ জন। এখন আছে মাত্র ৩৮৪ জন। সবশেষ নিয়োগে প্রশ্নফাঁস ও বিতর্কের কারণে জটিলতা তৈরি হয়েছে। পর্যন্ত পাঁচ দফায় ১৬০ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এর মধ্যে হাসপাতালে যুক্ত হয়েছেন মাত্র ৩২ জন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রশিক্ষণই বন্ধ করে দিয়েছে কোরিয়া।
এসব যন্ত্রপাতি ২০২২ সালের আগস্ট ও ডিসেম্বরে দুই ধাপে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে দক্ষিণ কোরিয়ান বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান। এসব যন্ত্রের সর্বোচ্চ মেয়াদ রয়েছে তিন বছর। ফলে ব্যবহারের আগেই শেষ মেয়াদের প্রায় দুই বছর।
১০০ শয্যার আইসিইউ সেবা রয়েছে হাসপাতালটিতে। এছাড়া ১০০ শয্যার জরুরি ইউনিট, ছয়টি ভিভিআইপি, ২২টি ভিআইপি ও ২৫টি ডিলাক্স কেবিন রয়েছে। যেগুলোর কোনোটিই ব্যবহার হচ্ছে না। উদ্বোধনের কিছু অস্ত্রোপচার হলেও এখন তাও বন্ধ।
হাসপাতালটি পুরোদমে সেবা চালু করতে না পারার কারণ হিসেবে জনবল সংকটকেই দায়ী করছেন উপাচার্য।
বিএসএমএমইউ উপাচার্য বলেন, 'আগের যে ভিসি ছিলেন তিনি যে নিয়োগপত্র আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন তাদেরকে যদি নিয়োগ দেয়া হয় তাহলে তাদেরকে বৈধতা দিতে আমার পক্ষে কঠিন হবে।'
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশমুখিতা কমানো এবং দেশেই আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসার জন্য তৈরি হলেও ব্যবসায়িক চিন্তাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে হাসপাতালটির কর্তৃপক্ষ- যাতে উচ্চ খরচের বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে বিশেষায়িত এই হাসপাতালের কোন পার্থক্যই থাকছে না।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, 'প্রথম থেকেই এই হাসপাতাল জাতীয় স্বার্থে চিন্তা করে করা হয়েছে সেই লক্ষে কেউ কাজ করেনি।'
৭৫০ শয্যার এ হাসপাতালটি ২০২২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন করা হয়। এমন আরও একটি হাসপাতাল তৈরি করে দিতে চায় দেশটি। যদিও নানা অব্যবস্থাপনায় ধুঁকে ধুঁকে চলা এ হাসপাতালের পূর্ণাঙ্গ সেবা চালু না করে নতুন নির্মাণে অর্থায়ন করতে নারাজ দেশটি।