দেশে এখন
0

নানা সংকটে বরগুনার রাখাইন সম্প্রদায়; টেকসই পদক্ষেপ নিতে আহ্বান

বেঁচে থাকার যে স্বপ্ন চোখে নিয়ে একদিন নীল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সুদূর আরাকান থেকে এই বঙ্গদেশে এসেছিলেন রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ, সে স্বপ্ন যেন ক্রমশই আশায় নৈরাশ্যতে পরিণত হচ্ছে। নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার, ঐতিহ্যকে লালন করে বরগুনা সদরের বালিয়াতলী গ্রাম ও তালতলী উপজেলায় দীর্ঘদিন অতিবাহিত করলেও এরই মধ্যেই নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে এই আদিবাসী গোষ্ঠী অস্তিত্ব সংকটে পড়েছেন।

উপকূলীয় জেলা বরগুনার বুক চিরে বয়ে চলা প্রমত্তা পায়রা আর বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে রাখাইন সম্প্রদায় বসবাস করে। প্রায় ৩০০ বছর পূর্বে এই জনপদকে আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়ে জঙ্গল কেটে বসতি শুরু করেন। উনিশ শতকের শুরুতেও বরিশাল অঞ্চলে ৫০ হাজারের বেশি রাখাইন বসবাস করতো। ১৯০০ সাল থেকে ১৯৪৮ সালে এই সংখ্যা হয় ৩৫ হাজার। ২০১৪ কারিতাসের জরিপে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ৫৬১ জনে। বরগুনার বালিয়াতলীতে কিছুদিন আগে ৬৫টি পরিবার থাকলেও বর্তমানে রয়েছে মাত্র ২৬টি পরিবার।

বরগুনা সদরের বালিয়াতলী রাখাইন পাড়ার সেক্রেটারি মংচং মনজু রাখাইয় বলেন, 'অতীতে আমাদের অনেক জমিজমা ছিল। স্থানীয়রা বিভিন্ন রকম প্ররোচনার মাধ্যমে সেগুলো দখল করে নেয়, হামলা মামলারও শিকার হই বিভিন্ন সময়। এছাড়া, সিডরের পরই আমাদের তাঁত শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়ে, মানুষজন কর্মসংস্থানহীন হয়। মূলত অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে পরিবারগুলো এই এলাকা ছেড়ে যাচ্ছে।'

এখন টেলিভিশনের লাগাতার অনুসন্ধান ও স্থানীয়দের সাথে আলোচনায় দেখা যায়, মূলত কৃষি জমি কমে যাওয়া, কর্মসংস্থানের অভাব, নাজুক যোগাযোগ ব্যবস্থা, তাঁত শিল্পের বেহাল দশা ও মামলা মোকদ্দমার মারপ্যাঁচে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়ে ইতোমধ্যে অনেকেই বালিয়াতলী পাড়া ছেড়েছেন।

এছাড়া, চিকিৎসার ক্ষেত্রেও বালিয়াতলী রাখাইন পাড়া আলোর মুখ দেখেনি, এখানে হাতের নাগালে নেই কোনো কমিউনিটি ক্লিনিক। বর্ষা মৌসুম বা ঝড় এলেই বাঁধ ভেঙে লবণ পানিতে পুরো এলাকা প্লাবিত হয়। পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও সুপেয় পানির অভাবে নানা শারীরিক জটিলতায় সম্মুখীন হয় রাখাইন শিশুরা। প্রাকৃতিক দুর্যোগে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়াসহ দুর্যোগকালীন সময়ে অলস জীবনযাপনে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যয়ে পড়ে যায় রাখাইন পরিবারগুলো।

চাঁন নামেরএকজন শিক্ষার্থী বলেন, 'বর্ষাকাল কিংবা ঘূর্ণিঝড় এলে আমাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। গ্রামের পথঘাট চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যায়। পড়ালেখায় ব্যাপক ক্ষতি হয় আমাদের সবার।'

নিজস্ব অনুষ্ঠান পান করছে রাখাইনরা। ছবি: এখন টিভি

নদীর এক পাড়ের বাতাসে বিষাদের সুর থাকলেও প্রমত্তা পায়রার ওপারে তালতলী উপজেলার রাখাইন পল্লিতে কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস বইছে। তালতলী উপজেলার ১ টি পাড়ায় হাজাও সমস্যা থাকলেও সেখানকার রাখাইনরা এখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।

বরগুনা সদর থেকে তালতলীর দূরত্ব প্রায় ৩৬ কিলোমিটার হলেও খেয়া পাড়ি দিয়ে তালতলীর রাখাইন পাড়ায় যেতে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে দু'ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। তালতলীর ১৩টি রাখাইন পাড়ায় শেকড় আঁকড়ে বসবাস করছে রাখাইন পরিবারগুলো। বৈচিত্র্যময় জীবনযাপন এখানকার রাখাইন সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ।

এখানকার রাখাইন বিহার ও প্যাগোডায় ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে কষ্টি পাথরসহ, দুর্লভ ধাতুর তৈরি মূল্যবান অনেক প্রাচীন মূর্তি ছিল। চুরি ও পাচারের কারণে প্রাচীন মূর্তির সংখ্যা কমে গেছে।

বরগুনার তরুণ পর্যটন উদ্যোক্তা আরিফুর রহমান বলেন, 'রাখাইনরা বরগুনা সংস্কৃতির অলংকার স্বরূপ। রাখাইন বৌদ্ধমন্দিরের বিভিন্ন রকমের মূর্তি চুরি হয়ে যাওয়া খুবই দুঃখজনক বিষয়। বরগুনার পর্যটনের বিকাশে রাখাইন সংস্কৃতি ও অস্তিত্ব রক্ষা করার কোনো বিকল্প নেই।'

ধর্মীয় ঐতিহ্যের পাশাপাশি তাঁত শিল্প রাখাইনদের সমৃদ্ধ ইতিহাসের জানান দেয়। রাখাইন তাঁতিদের হস্তচালিত তাঁতে উৎপাদিত নানা কারুকাজে তৈরি সকল বস্ত্রের কদর দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের সর্বত্রই রয়েছে। কিন্তু সুতার মূল্য বৃদ্ধি, পণ্য সরবরাহে জটিলতা, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার দরুন পর্যটকদের সমাগম কম হওয়ায় তালতলীর তাঁতশিল্প এখন বিলুপ্তির পথে।

স্থানীয় অধিবাসী এম এন রাখাইন বলেন, 'এখানকার রাখাইনরা মূলত হস্তশিল্পের উপর নির্ভরশীল নির্ভর করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু রাস্তাঘাটের দুরবস্থার দরুন পর্যটকদের আনাগোনা কম হওয়ায় এবং হস্তশিল্প তৈরিতে যেসব কাঁচামাল ব্যবহৃত হয় সেগুলোর মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় রাখাইনরা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে আছে। অন্যদিকে, রাখাইনদের ভাষার অস্তিত্বও সংকটের মুখে। পাড়ায় পাড়ায় রাখাইন ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র না থাকায় শিশুরা রাখাইন ভাষাজ্ঞান লাভ করতে পারছে না।'

এখন টেলিভিশনের অনুসন্ধানে রাখাইনদের ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কিয়াংগুলোর বিলুপ্তির বিষয়টিও উঠে আসে। অতীতে প্রতিটি পাড়ায় একাধিক কিয়াং থাকলেও বর্তমানে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সেসব রাখাইন ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাখাইন শিশুরা রাখাইন মাতৃভাষা ভাষা শুধু বলতে পারছে, লিখতে পারছে না তারা।

স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনও এ অঞ্চলে রাখাইনদের অস্তিত্ব সুদৃঢ় করতে রাখাইন মাতৃভাষা সংরক্ষণ, তাঁত ও পর্যটন শিল্পের প্রসারে গুরুত্বারোপ করেন।

'কাউকে পেছনে ফেলে নয়' সরকারের এ শ্লোগানকে সামনে রেখে তারাও উপকূলের রাখাইনদের জীবনমানের উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপের আশ্বাস দেন।

বরগুনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক আরিফুল রহমান মারুফ মৃধা বলেন, 'মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে বাঙালির সকল আন্দোলন সংগ্রাম ও সংস্কৃতিতে রাখাইনদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। রাখাইনদের অর্থনৈতিক দিয়ে যাতে স্বাবলম্বী হতে পারে সেদিকে সকলের এগিয়ে আসা উচিত।'

রাখাইন সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহা: রফিকুল ইসলাম বলেন, 'বরগুনা রাখাইন সম্প্রদায়ের জীবনমান, তাদের শিল্প-সংস্কৃতি ও জীবিকার বিষয়ে জেলা প্রশাসন থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মোহনা পর্যটন কেন্দ্র, শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকত, সোনাকাটা ইকোপার্ককে ঘিরে পর্যটন বিকাশে কাজ করে যাচ্ছে জেলা প্রশাসন।'

পর্যটন শিল্পের প্রসারের দরুন রাখাইনদের তাঁত শিল্প দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হয়ে চলে যাবে বিশ্ব দরবারে। ফলে সমৃদ্ধ হবে রাখাইনদের অর্থনীতি এবং সুদৃঢ় হবে রাখাইনদের বসতি। একটি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সবাই যেখানে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে রাখাইন সম্প্রদায়ের জীবনে তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। তদুপরি, এদেশে অলস জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকতে তারাও নারাজ।

সুদমুক্ত ব্যাংক ঋণ, উপকূলের তাঁত ও পর্যটন শিল্পের প্রসারসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ বরগুনায় রাখাইনদের ভিত সুদৃঢ় করবে এমনটাই প্রত্যাশা অবহেলিত এ জনগোষ্ঠীর।

এসএস